পুরোনো দিনের এমন অনেক কিছুই সামনে আনছে ইউফোরিয়া হুইসপার নামের ফেসবুক পেজটি
পুরোনো দিনের এমন অনেক কিছুই সামনে আনছে ইউফোরিয়া হুইসপার নামের ফেসবুক পেজটি

কয়েক প্রজন্মের স্মৃতি জমা হচ্ছে যেখানে

সারা দিনের ট্রেন্ডিং ও ভাইরাল সব ভিডিওতে ভর্তি ফেসবুক ফিড। রিলস দেখতে দেখতে আঙুল ও চোখ ভীষণ ক্লান্ত। তারপরও স্ক্রল করছি তো করছিই! হঠাৎ ফিডে এল পুরোনো দিনের একটা ভিডিও। ভগ্নিপতিকে ডাব এগিয়ে দিতে দিতে এক তরুণ জিজ্ঞেস করছেন, ‘দুলাভাই, তয় কী মাছ আনুম?’

দুলাভাই একটু ভেবে বললেন, ‘ইলিশ মাছ আনিস।’ পরের দৃশ্যেই দেখা যাচ্ছে রাতে ঘরের দাওয়ায় দুলাভাই আয়েশ করে খেতে বসেছেন, কিন্তু তাঁর মুখে রাজ্যের বিরক্তি, ‘উহহু! এত ঝাপসা আলো, কাটাকুটা কিছুই দেহি না।’ তখন বৈঠকখানার বাতিটি এনে লাগানো হলো দাওয়ায়। এরপর দুলাভাইয়ের মুখে সন্তুষ্টির হাসি, ‘আহ্! কী তামশা। সব কী ফকফকা! ও মানিক, কী বাত্তি লাগাইলি?’

ফিলিপস বাল্বের বিজ্ঞাপনটি আজও মনে রেখেছে মানুষ

মানিক, অর্থাৎ ওই তরুণের উত্তর কী শুনব, তার আগেই পাশ থেকে স্বয়ং আমার মা বলে উঠলেন, ‘ক্যা! ফিলিপস! আলোও যেমন, টেকেও তেমন! মাছের রাজা ইলিশ আর বাত্তির রাজা ফিলিপস।’

মায়ের মুখে বিজ্ঞাপনটির সংলাপ শুনে ভিডিওটা আবার পেছনে টেনে শুনলাম। তাজ্জব বনে গেলাম, আমার মা একেবারে হুবহু সংলাপ বলে দিয়েছেন! জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কি আগে টিভিসি মুখস্থ করতে?’

১৯৯৭ সালে বিটিভিতে প্রচারিত ‘তোমারই বসন্ত দিনে’ নাটকের দৃশ্যে বিপাশা হায়াত ও তৌকির আহমেদ

মা বললেন, ‘আমাদের সময় তো আর এখনকার মতো এত এত টিভি চ্যানেল ছিল না। একটা চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেখালে অন্য চ্যানেলে চলে যেতে পারতাম না। চ্যানেল ছিল একটাই—বিটিভি, তাই বিজ্ঞাপনও দেখতাম মনোযোগ দিয়ে। তখনকার অধিকাংশ বিজ্ঞাপনই আমাদের কাছে ছিল মজার। তাই সব আপনা–আপনি মুখস্থ হয়ে যেত। এ কারণে এখনো মনে আছে।’

অতীতে ফিরে যাওয়ার টাইম মেশিন

মায়ের কথা শুনে আশি ও নব্বইয়ের দশকের বিজ্ঞাপন এবং নাটকের প্রতি আগ্রহ জন্মাল। ১৯৮৯ সালের ফিলিপস বাল্বের বিজ্ঞাপনটা দেখছিলাম ইউফোরিয়া হুইসপার (Euphoria Whisper) নামের একটি ফেসবুক পেজে। ওই পেজেই কিছুক্ষণ স্ক্রল করতে করতেই কাজটা আরও সহজ হয়ে গেল। কারণ, এই পেজ মূলত পুরোনো দিনের সব বিজ্ঞাপন, নাটকসহ বিভিন্ন কনটেন্ট তুলে ধরে। দেখতে দেখতে পুরোনো দিনের কনটেন্টে বুঁদ হয়ে গেলাম।

২০০৪ সালে প্রচারিত প্রাণ বাবল গামের বিজ্ঞাপন

হিসাব করে দেখলাম, ছবি, ভিডিও, রিলস এবং লেখাসহ প্রায় ৮০০ পোস্ট আছে এই পেজে। আমার প্রজন্ম, অর্থাৎ জেন–জির অনেকে ভাবতে পারেন টিভি, ফেসবুক আর ইউটিউবে বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতেই যেখানে চোখ ব্যথা হয়ে যায়, শখ করে আবার পুরোনো দিনের বিজ্ঞাপন দেখার মানেটা কী? মানে আছে। বিশেষ করে আশি ও নব্বইয়ের দশকের দর্শকের কাছে এসব কনটেন্ট তুমুল স্মৃতিজাগানিয়া আনন্দের খনি।

একুশে টেলিভিশনের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘আমাদের কথা’, উপস্থাপনা করতেন নিমা রহমান

ফলে ইউফোরিয়া হুইসপার পেজের কনটেন্ট কেবল পুরোনো দিনের বিজ্ঞাপন বা ভিডিও নয়, এসব অনেকের কাছে শৈশব, কৈশোর বা তারুণ্যে ফিরে যাওয়ার টাইম মেশিন। এই পেজে ঠাঁই পাওয়া পুরোনো দিনের বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল, নাটকের বিশেষ মুহূর্ত, কার্টুন, বিদেশি সিরিজ, কমিকস, আলোকচিত্র, মিউজিক ভিডিও—সবই পেয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়তা, এখন আবার পুরোনো ও নতুন প্রজন্মের সামনে যাচ্ছে এবং আবারও জনপ্রিয় উঠছে। প্রমাণ? কনটেন্টগুলোর ভিউ, কমেন্ট ও শেয়ারের সংখ্যা দেখলেই তা স্পষ্ট। কেবল কি সাধারণ দর্শক? পুরোনো দিনের কনটেন্টগুলোর কুশীলব, নির্মাতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও এসব পছন্দ করছেন, শেয়ার করছেন ভালোবাসার সঙ্গে। ফলে ইউফোরিয়া হুইসপার পুরোনো প্রজন্মকে করে তুলছে নস্টালজিক, আর নতুনদের সামনে হাজির করছে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস।

স্মৃতিজাগানিয়া ভান্ডার

১৯৯৬ সালে বিটিভির সংবাদ উপস্থাপনা করছেন উপস্থাপিকা রওশন মোস্তফা শাওন

১৯৮০ সালে একটি সাদা–কালো মিউজিক ভিডিও দেখে বেশ মজাই লাগল। বিখ্যাত বনি এম–এর ‘রাসপুটিন’ গানটি অনেকের শোনা। তবে এর যে একটা বাংলা সংস্করণও আছে, তা কে জানত! গানটির শিরোনাম ‘মুসাফির তুমি’। এ রকম আরও অনেক চমকপ্রদ কনটেন্ট ও এসবের অজানা ইতিহাস দেখতে পেলাম ইউফোরিয়া হুইসপার পেজে।

’সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ’, কনকা টিভির বিজ্ঞাপন (২০০৫)

ভিডিও কনটেন্টের পাশাপাশি বেশ কিছু স্মৃতিজাগানিয়া ছবিও আছে পেজটিতে। এসবের নিচে জমা হওয়া কমেন্টগুলোও দারুণ। কারণ, ছবিগুলোর সঙ্গে যাঁদের স্মৃতি আছে, তাঁরা যখন অল্প কথায় অতীত দিনের কথা মনে করিয়ে দেন, পড়তে বেশ লাগে। কমেন্টে কিছু না পেলেও আপনার পরিবারের বড়দের কাউকে দেখালেও জানতে পারবেন অজানা মজার সব গল্প। কেননা ছবিগুলোর সঙ্গে হয়তো জড়িয়ে আছে তাঁদের দারুণ সব গল্প ও স্মৃতি।

কে চালাচ্ছেন পেজটি

খোঁজ নিয়ে জানলাম, দারুণ কাজটি এক হাতে করছেন মোহাম্মদ সাফায়াত হোসেন নামের এক তরুণ। যোগাযোগ করলাম তাঁর সঙ্গে। প্রথম প্রশ্নটা ছিল, ‘ইউফোরিয়া হুইসপার নামটা বেছে নিলেন কেন?’

১৯৯০ সালে বিটিভিতে প্রচারিত ’আমরা ক’জন’ অনুষ্ঠানের একটি মুহূর্ত

সাফায়াত বললেন, ‘ইউফোরিয়া শব্দের অর্থ উচ্ছ্বাস বা সুখের তীব্র অনুভূতি আর হুইসপার অর্থ ফিসফিস করে কথা বলা। এই পেজের কনটেন্টগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পুরোনো প্রজন্মের মানুষদের অতীত কতটা সহজ উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ ছিল; মোবাইল ফোন বা আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াও তাঁদের প্রতিটা মুহূর্ত ছিল কতটা আনন্দের। সেসবই আবার ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি ইউফোরিয়া হুইসপারের মাধ্যমে। এখনকার প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটা সুন্দর নাম বেছে নেওয়ার চেষ্টা থেকেই এমন নামকরণ।’

১৯৯১ সালে বিটিভিতে প্রচারিত মিল্লাত বামের বিজ্ঞাপন

ইউফোরিয়া হুইসপার কি আর্কাইভ হয়ে উঠবে

তবে ইউফোরিয়া হুইসপার তো আর্কাইভের মতো কাজটাও করছে। স্মৃতি সংরক্ষণ করছে। এ বিষয়ে সাফায়াত কী বলেন? তাঁর উত্তর, ‘হ্যাঁ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে প্রচারিত দুর্লভ কনটেন্টগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বা ভুলে যাচ্ছে সবাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন পুরোনো বিজ্ঞাপন বা ফুটেজ শেয়ার করেন। সবাই খুব পছন্দ করলেও সেসবের সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকে না। এই চিন্তা থেকেই কাজ করে যাচ্ছি, যাতে কনটেন্টের সঙ্গে ইতিহাসটাও থাকে। বাংলাদেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞাপন নির্মাতা এজেন্সিগুলোর সহায়তা পেলে দর্শকের সামনে আশি-নব্বই দশকের আরও বিজ্ঞাপন ও কনটেন্ট শেয়ার করতে পারব। ভবিষ্যতে এসব নিয়ে একটা ওয়েবসাইট বানাব বলেও ভেবে রেখেছি। আশা করি, কয়েক বছরের মধ্যে ইউফোরিয়া হুইসপার কয়েক প্রজন্মের স্মৃতির আর্কাইভ হয়ে উঠবে।’

আশি–নব্বই দশকে বিটিভির দর্শকমাত্রই জানেন এর মানে