মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো।
সংগ্রহকারী: ইমন বড়ুয়া, নবম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, রাঙামাটি
বর্ণনাকারী: পরিমল বড়ুয়া, সদর, রাঙামাটি
সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: জ্যাঠা–ভাতিজা
আমার বয়স তখন ২৩ বছর। পথে, মাঠে আর স্কুলে চানাচুর বানিয়ে বিক্রি করি। হঠাৎ একদিন রেডিওতে শুনতে পাই, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এলাকায় এসে পড়েছে। কিছুদিন পর রাঙামাটিতে হঠাৎ গোলাগুলি আর বোমার আওয়াজ।
রাঙামাটিবাসী ভয়ে বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে গেল। আমরাও একটা বড় নৌকায় করে কিল্লামুড়া নামের জায়গায় এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। সেখানে গিয়ে অনাহারে ভীষণ কষ্টে দিন কাটতে লাগল।
একদিন নৌকায় করে জঙ্গলে গেলাম কাঠ কুড়িয়ে আনব বলে। তখন দেখি, ২৫-৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা পাহাড় থেকে নামছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন গুলিবিদ্ধ। কয়েকজন ছিলেন পাহাড়ি, বেশির ভাগই সমতলের।
আমাদের নৌকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নদীর অন্য পাড়ে যেতে সাহায্য করলাম। তাঁরা আর বেশি দেরি না করে ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের দিকে রওনা হলেন। হঠাৎ শুনতে পেলাম ট্রলারের ইঞ্জিনের শব্দ। তাড়াতাড়ি নৌকা নিয়ে পালিয়ে গেলাম।
তারপর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় শুনতে পেলাম, রাঙামাটি সদর ছেড়ে যাঁরা পালিয়েছেন, তাঁরা ঘরে ফিরে না গেলে সব পুড়িয়ে দেওয়া হবে। বাধ্য হয়ে আমরা বাড়ি ফিরলাম।
গিয়ে দেখি, পাকিস্তানি সেনারা রাঙামাটির বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প করেছে। সবচেয়ে বড় ক্যাম্পটি ছিল বর্তমান রাঙামাটি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও পুলিশ সুপারের বাসভবনের মাঝামাঝি এলাকায়।
পাকিস্তানিদের কাছে তখন ছিল বিপুল গোলাবারুদ, নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আর বড় বড় গাড়ি। রাঙামাটি সদর এলাকায় সন্ধ্যা ছয়টা বাজার পর কারফিউ শুরু হতো। ছয়টা বাজার পর কাউকে বাইরে পেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি।
পাকিস্তানি বাহিনী অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে চোখ বেঁধে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। লাশগুলো ফেলে দেয় মানিকছড়ির পাহাড়ের নিচে।
তখন রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন এম আর আলী। তাঁর ছেলে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি একদিন ভুলে পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে পড়ে যান।
পাকিস্তানি সেনারা বুঝে ফেলে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তবে শেষ মুহূর্তে তিনি গুলি করে দুজন পাকিস্তানি সেনাকে মেরে নিজের বন্দুক মাথায় ঠেকিয়ে গুলি চালান, অর্থাৎ আত্মাহুতি দেন।