ব্রাজিল থেকে ফুটবল খেলতে বাংলাদেশে এসেছেন দানিলো আকুইপা। প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই সঙ্গে এনেছেন। তার মধ্যে আছে একটি বালিশ আর কম্বলও। ঢাকার ফুটবল ক্লাব ফর্টিস এফসি লিমিটেডের ডিফেন্ডারের কাছে সেই বালিশ-কম্বলের গল্প শুনেছেন রাশেদুল ইসলাম

সকালের নাশতা করছিলেন দানিলো আকুইপা। চেয়ারের ওপর কম্বল-বালিশ রেখে তার ওপর বসেছেন তিনি। ভাবলাম, প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার ব্রাজিলিয়ান তরুণ বুঝি নিচু চেয়ারে আরাম করে বসার জন্য কৌশলটা বেছে নিয়েছেন। নাশতা শেষে ভুল ভাঙালেন ২৮ বছর বয়সী দানিলো। ক্লাবের দেওয়া কম্বল ও বালিশ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এগুলোর প্রয়োজন নেই!’
দলের ম্যানেজার হিসেবে ভালো কম্বল-বালিশ দিতে না পারার ব্যর্থতার শঙ্কায় কাঁচুমাচু করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার কি এগুলো পছন্দ হয়নি?’ জবাবে কিছু না বলে নিয়ে গেলেন তাঁর রুমে। বাড্ডার বেরাইদের আবাসিক ক্যাম্পের রুমটায় দেখালেন একটা পুরোনো কম্বল ও পাতলা বালিশ। যা সুদূর ব্রাজিল থেকে ঢাকায় নিয়ে এনেছেন তিনি। কোলের মধ্যে নিয়ে বসে সে নরম ও মোলায়েম কম্বল হাতড়াতে হাতড়াতে শোনালেন মায়ের মমতা মাখা বিশুদ্ধ ওমের গল্প।
ব্রাজিলের দক্ষিণাঞ্চলের রোরাইমা প্রদেশে দানিলোর জন্ম। মা ৫৬ বছর বয়সী সানিয়া কলেজের পর্তুগিজ ভাষাশিক্ষক আর বাবা সেলসো ব্যাংকে চাকরি করেন। ভালোবেসে বাঁ হাতের ট্যাটুতে মায়ের আর ডান হাতের ট্যাটুতে বাবার নাম। এতে মাতৃভূমি ব্রাজিল থেকে প্রায় ১৫ হাজার ৯১৫ কিলোমিটার দূরে থাকলেও দানিলোর সঙ্গেই যেন থাকেন মমতাময়ী মা আর বাবা। আর ঢাকায় নিয়ে আসা মায়ের দেওয়া কম্বলটা তো দানিলোর জন্য স্নেহ-ভালোবাসার ওমের ভান্ডার।
সানিয়া-সেলসো দম্পতির এক মেয়ে ও তিন ছেলের মধ্যে দানিলো মেজ। পরিবারে তিনিই একমাত্র ফুটবলার। ২০১৫ সালে দানিলোকে কম্বলটি কিনে দেন তাঁর মা। সেই থেকে এই কম্বলের ওম ছাড়া দানিলোর যেন ঘুম হয় না। যার জন্য কম্বলটি নিয়ে দানিলো এরই মধ্যে পাড়ি দিয়েছেন প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কিলোমিটার পথ। সীমান্তের কাঁটাতার পেড়িয়ে একে একে ঘুরে বেড়িয়েছে ইউরোপের মাল্টা, এশিয়ার ভারত ও বাংলাদেশ।
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে মাল্টায় খেলতে যান দানিলো। তাঁর লাগেজে সঙ্গী হয় কম্বল। পরের দুই মৌসুম ভারতের আই লিগে খেলার সময়ও কম্বলটি হয়েছে দানিলোর সঙ্গী। আর এবার নিয়ে টানা দুই মৌসুম বাংলাদেশে খেলতে এসে তাঁর সঙ্গী হয়েছে কম্বলটি। এবার বিপিএল অনুষ্ঠিত হবে দেশের ছয়টি ভেন্যুতে। যে ভেন্যু শহরে আগের দিন গিয়ে রাত্রি যাপন করতে হবে, সেখানেও ফর্টিসের অধিনায়কের সঙ্গী হবে কম্বল।
দানিলো নিজেও এখন দুই ছেলের বাবা। পরিবার বড় হওয়ায় মা-বাবার থেকে আলাদা হয়ে পাশের একটা বাড়িতেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন। বাড়ি আলাদা হলেও মায়ের মতো ভালোবাসা অটুট। কম্বল হাতে নিয়ে বলছিলেন, ‘এই কম্বলের প্রধান বিশেষত্ব, এটা আমার মা দিয়েছেন। এর মধ্যে শান্তি খুঁজে পাই। ঘুম ভালো হলে ভালো খেলতে পারব ও ভালোভাবে অনুশীলন করতে পারব। আমি নিজেই কম্বলটি নিয়মিত পরিষ্কার করি।’
এবার আসা যাক ব্রাজিল থেকে নিয়ে আসা বালিশের গল্পে। ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার সময় লাগেজের মধ্যে বালিশটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন দানিলোর স্ত্রী। বালিশ নরম না হলে দানিলোর ঘুম হয় না বলেই স্ত্রীর এই ব্যবস্থা। আসলে এ তো একটা কম্বল আর বালিশ নয়, দৈনন্দিন ব্যবহারের দুটি জিনিসে দানিলো যেন খুঁজে পায় মায়ের স্নেহ ও প্রিয়তমা স্ত্রীর ভালোবাসা।