নেপালে কাঠমান্ডু ম্যারাথনের ১৭তম আয়োজনে ১৩০ দেশের প্রতিযোগীর মধ্যে নিজের শাখায় দ্বিতীয় হয়েছেন বাংলাদেশের হামিদা আক্তার
নেপালে কাঠমান্ডু ম্যারাথনের ১৭তম আয়োজনে ১৩০ দেশের প্রতিযোগীর মধ্যে নিজের শাখায় দ্বিতীয় হয়েছেন বাংলাদেশের হামিদা আক্তার

দেশ–বিদেশের ম্যারাথনে জেবা জিতেছেন লাখ লাখ টাকা

১ নভেম্বর নেপালে হয়ে গেল কাঠমান্ডু ম্যারাথনের ১৭তম আয়োজন। এতে অংশ নিয়ে ১৩০ দেশের প্রতিযোগীর মধ্যে নিজের শাখায় দ্বিতীয় হয়েছেন বাংলাদেশের হামিদা আক্তার। সবার কাছে জেবা নামে পরিচিত এই দৌড়বিদের গল্প শুনুন জিনাত শারমিন–এর কাছে।

ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার বাস ধরতে কার্জন হলের দিকে যাচ্ছিলেন হামিদা আক্তার। হঠাৎ চোখে পড়ে জিমনেসিয়াম মাঠে মানুষের ভিড়। অনেক দৌড়াচ্ছেন দেখে এগিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, আন্তহল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে।

পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ের চক্কর দিচ্ছেন ছাত্ররা। কথায় কথায় জানতে পারলেন, মেয়েদের হলেও খেলা হয়, তবে তাঁদের জন্য এত লম্বা দৌড় হয় না—সর্বোচ্চ ৪০০ মিটার! তিনি ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিতে চান শুনে একজন বলে ওঠেন, ‘তুমি এত দূর দৌড়াতে পারবা না!’ আরেকজন বললেন, ‘মেয়েরা আবার ম্যারাথন করবে কী? মাথা ঘুরে পড়ে যাবে না?’

সেই কথাকেই যেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন জেবা। ঢাকাতেই জেবার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়ার সময় বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হ্যান্ডবল দলে ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমআইএসের (ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম) তৃতীয় বর্ষে উঠে যেদিন জিমনেসিয়ামের মাঠে দৌড় দেখে জানলেন, আন্তহল ক্রীড়া প্রতিযোগিতার কথা, সেদিনই বাড়ি ফিরে আগে হলে খোঁজ নিলেন। তত দিনে সুফিয়া কামাল হলে সেই বছরের খেলা হয়ে গেছে।

পরের বছর প্রথমে হলের ভলিবল টিমে নাম লেখালেন জেবা। রাতে প্র্যাকটিস করতে হতো। তাই মাঝেমধ্যে হলে থাকা শুরু করলেন। একে একে ফুটবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন, হ্যান্ডবল, অ্যাথলেটিকস দলেও যোগ দিলেন। ২০২০ সালে অ্যাথলেটিকসে হল চ্যাম্পিয়ন হন জেবা।

বাংলাদেশের পতাকা হাতে জেবা

অবশ্য ম্যারাথনে এর আগেই নাম লিখিয়েছেন। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ কিলোমিটার দৌড় প্রতিযোগিতা দিয়ে জেবার স্বল্প দূরত্বের দৌড় শুরু। আস্তে আস্তে বাড়াতে থাকেন দৌড়ের পরিধি।

নরসিংদীতে সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেন ‘দ্য গ্রেট বাংলাদেশ রান’ আয়োজিত ১০ কিলোমিটার দৌড়। পরে বান্দরবানে পাহাড়ি পথে ২১ কিলোমিটার ব্যান্ড্রাথন ম্যারাথনে নারীদের মধ্যে হন প্রথম। এরপর কেবলই ছুটে চলা।

২০১৯ সালে ভারতের মেঘালয়ে মাওকিরওয়াত ট্রেইল আলট্রাতে দৌড়ালেন ৪৫ কিলোমিটার। একই বছর বাংলাদেশের গাজীপুরে দৌড়ালেন ৫০ কিলোমিটারের আলট্রা ম্যারাথন।

২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকা ম্যারাথনে অংশ নিয়ে নারীদের মধ্যে প্রথম হয়ে পান পাঁচ লাখ টাকার চেক। ২০২২ সালে ভারতের লাদাখ ম্যারাথনে নারীদের মধ্যে হন পঞ্চম। আর ১ নভেম্বর নেপালের কাঠমান্ডু ম্যারাথনে পূর্ণ দূরত্বের ম্যারাথনে নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছেন জেবা।

শুরুতে মেডেল বাসায় নিতেন না

একের পর এক ম্যরাথনে দৌড়ে মেডেল জিতে চলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্রী

জেবার কাছে জানতে চাইলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ-এমবিএ করে আপনি যে অ্যাথলেট হতে চাইলেন, বাসায় আপত্তি করল না? বললেন, ‘শুরুতে ভয়ে বাসায় জানাইনি। মাসের পর মাস মেডেল, ক্রেস্ট কিছুই বাসায় নিইনি। হলেই লুকিয়ে রাখতাম। তবে যেহেতু খেলায় ভালো করছিলাম, টিভিতে সাক্ষাৎকার নিত।

আব্বু খবর দেখতে বসলেই ভয়ে ঢিপঢিপ করত বুক। মাঝেমধ্যে আব্বু টিভির সামনে থেকে উঠলে আস্তে করে টিভি বন্ধ করে দিয়ে চলে আসতাম। পত্রিকায় নাম আসত। আত্মীয়স্বজন কেউ দেখলে বাসায় জানাত।’

‎তারপর? জেবা বলতে থাকলেন, ‘আস্তে আস্তে জানতে থাকল। আস্তে আস্তে প্রতিক্রিয়া কমতে থাকল আর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকল। প্রায় দুই বছর সময় লেগেছে। এখন পরিবার আমাকে খুবই সমর্থন করে।’

রাজধানীর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক এই অ্যাথলেট। ক্লাসরুম সামলেই গত সাত বছরে শতাধিক ম্যারাথনে দৌড়েছেন জেবা। জমিয়ে ফেলেছেন এক শোকেস ক্রেস্ট–মেডেল।

কাঠমান্ডু ম্যারাথনে দ্বিতীয় হয়েছেন জেবা

দৌড়ে অংশ নিতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকা ম্যারাথনের আগে অল্প সময়ে এত অনুশীলন করেছিলেন যে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে সব প্রতিযোগীর শেষে শুরু করেন ম্যারাথন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, হাঁটতে হাঁটতে। ভলান্টিয়াররা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসিও করছিলেন।

জেবার পেছন পেছন চলছিল অ্যাম্বুলেন্স। সেই ম্যারাথনে মাঝপথে বনানীতে মেডিকেল বুথের কাছে এসে রাস্তায় বসে পড়েন। তারপর নিজেই নিজের পা ম্যাসাজ করে হাঁটা শুরু করেন। কিছুক্ষণ হেঁটে শুরু করেন হালকা দৌড়। সেই সময় অনেকে তাঁকে ম্যারাথন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলেছিল।

তবু যেকোনো মূল্যে দৌড়টা শেষ করতে চাইছিলেন জেবা। সেই ম্যারাথনে জেবা প্রায় দেড় ঘণ্টা বিশ্রামই নিয়েছেন। থেমেছেন, কিন্তু রেস ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত ঠিকই ম্যারাথনটা শেষ করেছিলেন জেবা। আর শেষ করে পেয়েছিলেন অদ্ভুত এক প্রশান্তি। সেই ম্যারাথনের পর নিজের ফিটনেস বিষয়ে আরও সচেতন হন জেবা।

‎জেবা বলেন, ‘দেশের বাইরে যতবার দেশের পতাকা নিয়ে ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করি, খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আশপাশ থেকে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বলে চিৎকার করে, হাততালি দেয়। এ রকম মুহূর্ত জীবনে আরও অনেকবার পেতে চাই। এমন সব ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করতে চাই, যেগুলো বাংলাদেশের কোনো নারী আগে করেননি।’