
রোবটপ্রেমীদের নিয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) বসেছিল জমজমাট এক আসর। মেকাট্রনিকস ও শিল্পপ্রকৌশল বিভাগের এ আয়োজনের নাম জাতীয় রোবোটিকস ও প্রযুক্তি উৎসব। ৮ থেকে ১০ মে নানা প্রতিযোগিতায় মেতে ছিল পুরো ক্যাম্পাস।
মাঠটি দৈর্ঘ্যে মাত্র ৯ ফুট, প্রস্থে ৫ ফুট। এইটুকুন মাঠ ঘিরেই ভিড় করেছিলেন উৎসুক দর্শনার্থীরা। তাঁদের করতালি, স্লোগানের মধ্যে জমে উঠেছে খেলা। হোক না খেলোয়াড়রা রোবট, তবু এই ম্যাচকে ‘রুদ্ধশ্বাস’ বলাই যায়। ৫ মিনিটের ম্যাচে প্রতিটি গোলের জন্য ছিল ৩ পয়েন্ট। ফাউল হলে বা রোবট বন্ধ হয়ে গেলে কেটে নেওয়া হয়েছে ১ পয়েন্ট। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় দেশের নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা ২৬টি দল। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে টিম ব্ল্যাক সাবের। দলের সদস্য ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী মো. নাহিদ হোসাইন সরকার ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের দেবর্ষী দে।
সাদা-কালোর মিশ্রণে আঁকাবাঁকা একটা পথ আঁকা। সেই পথ ধরে ছুটছে ছোট ছোট যান। স্বল্প সময়ে পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পারলেই জয়ী। দেখতে গাড়ির মতো হলেও আদতে যানগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত রোবট। আর এই রোবটগুলো নিয়ে প্রতিযোগিতায় হাজির হয়েছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩৭টি দল। ইনফ্রারেড সেন্সরের সাহায্যে দিব্যি কালো দাগের উপস্থিতি শনাক্ত করে ফেলেছে রোবটগুলো। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে টিম সলভওয়ার। দলনেতা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এবারের প্রতিযোগিতার ট্র্যাকটি আমার দেখা সবচেয়ে কঠিন ট্র্যাকগুলোর একটি। প্রতিযোগিতার দিনই ট্র্যাকটি প্রথম দেখা। প্রস্তুতির জন্য খুব কম সময় পাওয়ায় এটি আমাদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রথমে কিছুটা নার্ভাস থাকলেও নিজেদের সক্ষমতা বিষয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ফলে জয় এসেছে।’
উৎসবের দ্বিতীয় দিনের বড় আকর্ষণ ছিল টেকাথন। হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের সমন্বয়ে বিভিন্ন বাস্তব সমস্যা দ্রুততার সঙ্গে সমাধান করেছেন প্রতিযোগীরা। আয়োজকদের দাবি, দেশে এবারই প্রথম এ ধরনের প্রতিযোগিতা হলো। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮টি দল টেকাথনে অংশ নেয়। প্রথম হয় ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মো. তানভীর হাসান, মো. মোবাশির হাসান ও সীমান্ত কুমার রায়ের দল আলফা।
দলনেতা তানভীর বলেন, ‘হ্যাকাথনে শুধু সফটওয়্যারের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে হয়। কিন্তু এবারই প্রথম হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার—দুটির সমন্বয়ে কাজ করতে হলো। প্রতিযোগিতাটি আমাদের জন্য একদমই নতুন অভিজ্ঞতা ছিল। বুয়েট, কুয়েট, চুয়েটসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দল অংশ নিয়েছিল। তাই শুরুতে ভেবেছিলাম, তাদের সঙ্গে হয়তো পারব না। কিন্তু শেষে যখন বিজয়ী হিসেবে আমাদের নাম ঘোষণা করা হলো, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। এ বিজয় আমাদের নিজেদের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বড় প্রাপ্তি।’
শেষ দিনে প্রযুক্তিপ্রেমীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। দিনভর মূল আকর্ষণ ছিল প্রকল্প প্রদর্শনী, যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা উদ্ভাবনী তরুণদের হাতে তৈরি প্রযুক্তির দেখা মিলেছে। কেউ এনেছেন বোমা নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম রোবট, কেউবা আগুন নেভাতে পারঙ্গম যন্ত্র। কেউ উপস্থাপন করেছেন বৈদ্যুতিক গাড়ি, আবার কেউ হাজির হয়েছেন কৃষিকাজে সহায়তা করতে পারে, এমন প্রযুক্তি নিয়ে। তবে দর্শনার্থী ও বিচারকদের বিশেষ নজর কাড়ে ‘বিদ্যার্থী’ নামের একটি মোবাইল অ্যাপ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারহান ইসলাম, জুনাইদ আলী ও মো. কাইফ ইবনে জামানের দল টিম এক্স-অর তৈরি করেছে এই অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবনের ত্রিমাত্রিক ম্যাপ, বিশ্ববিদ্যালয় বাসের অবস্থান, বহিরাগত শনাক্তকরণ, ফরম পূরণ, অনলাইন ফি প্রদান, খাবারের অর্ডার দেওয়া থেকে শুরু করে ক্লাস, পরীক্ষার রিমাইন্ডার অ্যালার্মসহ একাধিক সুবিধা একত্রে পাওয়া যাবে। এই উদ্ভাবনই প্রদর্শনী প্রতিযোগিতার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজয়ী হয়। দলনেতা পাভেল বলেন, ‘আমরা এমন একটি অ্যাপ বানাতে চেয়েছি, যা ছাত্রদের ক্যাম্পাসজীবন সহজ ও কার্যকর করবে।’
শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও তাদের মেধা আর উদ্ভাবনী শক্তির প্রমাণ দিয়েছে। নিজের তৈরি তিনটি রোবট দিয়ে স্কুল ও কলেজ বিভাগে বিজয়ী হয়েছে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মো. জগলুল করিম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে একটি রোবোটিকস কর্মশালায় অংশ নেওয়ার পর থেকেই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের প্রতি তার আগ্রহ। সে সময় কৃষিকাজে সহায়তা করতে পারে, এমন একটি রোবট তৈরি করেছিল এই কিশোর। ভবিষ্যতে তার রোবোটিকস নিয়ে আরও বড় পরিসরে গবেষণা করার ইচ্ছা আছে।
উৎসবে আরও ছিল ক্যাড সফটওয়্যারের মাধ্যমে নকশা তৈরি ও দাবা প্রতিযোগিতা। নকশা তৈরি প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) দল ফেনল এবং দাবা প্রতিযোগিতার বিজয়ী হন চুয়েটের শিক্ষার্থী দিব্য দাশগুপ্ত। ১০ মে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণীর মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসব। আয়োজকেরা জানান, এবার উৎসবে দেশের ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৯ শতাধিক বেশি প্রতিযোগী অংশ নিয়েছেন। অতিথি ছিলেন বিভিন্ন শিল্পকারখানার প্রতিনিধিরা। প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা সমমূল্যের পুরস্কার দিয়েছেন তাঁরা।
চুয়েটের মেকাট্রনিকস ও শিল্প প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রসঞ্জীত দাশ বলেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা, তাঁদের মেধা ও সৃজনশীলতাকে বাস্তব সমস্যা সমাধানে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দিতেই এ আয়োজন। আশা করি এই প্ল্যাটফর্ম শিক্ষার্থীদের রোবোটিকস ও প্রযুক্তিচর্চার প্রতি আগ্রহ বাড়াবে।’