কেন তবু কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়বে

কেন কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়ার গুরুত্ব কমবে না? এ প্রসঙ্গেই টাইম ডটকমে লিখেছেন মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী মার্কাস ফনটোরা। তিনি মাইক্রোসফটের ভাইস প্রেসিডেন্ট। পড়ুন তাঁর লেখার অনুবাদ।

মার্কিন কম্পিউটার বিজ্ঞানী মার্কাস ফনটোরা
ছবি: উইকিপিডিয়া

গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তি খাতের কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি বেতন ও চাকরির নিরাপত্তা পেয়ে এসেছেন। কিন্তু শ্রমবাজারে সম্প্রতি একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তি-পেশা ও প্রযুক্তি-দক্ষতার মূল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতিমধ্যে প্রযুক্তি খাতের এন্ট্রি-লেভেল বা প্রাথমিক পর্যায়ের অনেক চাকরির জায়গা দখল করতে শুরু করেছে। এই বছর ইন্টেল, মেটা, মাইক্রোসফটের মতো বড় প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। আর ট্রাম্প প্রশাসন গবেষণা অনুদানে কাটছাঁট করায় প্রযুক্তি খাতের আরও অনেক অংশ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

এসব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এখনো আমি মনে করি, কম্পিউটার বিজ্ঞান বা এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় যেমন কম্পিউটার প্রকৌশল, ফলিত গণিত, বা ডেটা সায়েন্সে ডিগ্রি নেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তগুলোর একটি।

কম্পিউটার বিজ্ঞান বা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা থাকার সবচেয়ে বড় কারণ হলো—ক্ষেত্রটা আদতে কী, সেটাই মানুষ জানে না। আমরা শিক্ষার্থীদের জটিল সমস্যা সৃজনশীলভাবে সমাধান করার কৌশল শেখাই। সেখানে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং কেবলই সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিটা সাজানোর একটি উপাদান।

আমি যখন ১৯৯৫ সালে কম্পিউটার প্রকৌশলে ডিগ্রি নিয়েছিলাম, তখন পৃথিবী অনেকটাই আলাদা ছিল। তখন ডব্লিউডব্লিউডব্লিউ (ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব) সবে শুরু হয়েছে। বড় কোনো সার্চ ইঞ্জিন ছিল না। ক্লাউড কম্পিউটিং ছিল না। মোবাইল ফোনও ছিল না। কিন্তু আমি কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভিত্তি শিখেছিলাম এবং সমস্যা সমাধানের প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম। আর সেই প্রশিক্ষণ আমাকে গত ২০ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করতে সাহায্য করেছে। যেমন গুগল সার্চ, মাইক্রোসফট অ্যাজিওর (মাইক্রোসফটের ক্লাউড কম্পিউটিং সার্ভিস)-এর অবকাঠামো উন্নয়ন।

আরেকটি বড় ভুল ধারণা হলো—এআই নাকি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট খাতকে অন্য যেকোনো খাতের চেয়ে বেশি বদলে দেবে। বাস্তবে এআই কর্মক্ষেত্রে খুবই প্রভাব ফেলবে এবং তা সব জ্ঞানভিত্তিক পেশাজীবিকেই ছুঁয়ে যাবে—শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপারদের নয়। খুব শিগগিরই আমরা দেখব, গ্রাফিক ডিজাইনার, আইনজীবী, হিসাবরক্ষক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীসহ অন্যান্য পেশার জন্যও অনেক এআই টুল আসবে।

এআইয়ের কাছে সফটওয়্যার খাতই সবচেয়ে ‘সহজলভ্য গিনিপিগ’, বিষয়টি এমন নয়। প্রোগ্রামিং ভাষার উন্নতি হচ্ছে, কম্পিউটারের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের ধরন বদলাচ্ছে, এসবের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক। তবে এতে সফটওয়্যার ডেভেলপারদের প্রয়োজন কমে যাবে—এমন নয়। আমাদের এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। আমাদের এমন দক্ষ মানুষ লাগবে, যাঁরা ক্রিটিকালি চিন্তা করতে পারেন, কঠিন সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তবে হ্যাঁ, মানুষের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা বদলে যাবে। সেটা সফটওয়্যার নির্মাতাদের পাশাপাশি অন্য সব পেশাজীবীর ক্ষেত্রেও।

এআই যে কাজটা খুব ভালোভাবে করতে পারে, তা হলো কাজের যন্ত্রগত বা নিয়মমাফিক অংশগুলোর ‘অটোমেশন’। সফটওয়্যার উন্নয়নের ক্ষেত্রে যদি আমরা স্পষ্ট নির্দেশনা দিই, এআই আমাদের জন্য কোড লিখে দিতে পারবে। একইভাবে মার্কেটিংয়ে যদি আমরা পণ্যের বিবরণ ও প্রচারণার লক্ষ্য যথাযথভাবে উল্লেখ করে দিই, এআই মার্কেটিংয়ের উপকরণ তৈরি করতে পারবে।

কিন্তু এখনো সেই সময় আসেনি, যখন এআই নিজে সিদ্ধান্ত নেবে কোন সফটওয়্যার সিস্টেম বানাতে হবে বা কোন পণ্য তৈরি করা উচিত। আর ভোক্তার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার মতো আবেগ-অনুভূতি এআই এখনো ছুঁতে পারে না। তাই এসব কাজের জন্য মানুষের প্রয়োজন আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে। আমাদের সব সময় এমন যোগ্য মানুষের প্রয়োজন পড়বে, যাঁরা জটিল সমস্যা সমাধান করতে পারেন।

জ্ঞাননির্ভর সব কর্মীকেই শেষ পর্যন্ত এআইয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এআই সব বদলে দেবে, শুধু এই কথা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। বরং তারা সেই বিষয় পড়ুক, যেটিতে তারা আগ্রহী, যেখানে তারা নিজেদের সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল মনে করে। তারা সেই ক্ষেত্র বেছে নিক, যেটিকে তারা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।

আমার ব্যক্তিগত পক্ষপাত থাকতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি—নব্বইয়ের দশকে যখন আমি গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এখন তার চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমাদের কাছে ভালো প্রযুক্তি আছে, বেশি কম্পিউটিং শক্তি আছে এবং সমাধান করার মতো অনেক বড় বড় সমস্যা আছে—যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, ক্ষুধা, স্বাস্থ্যসেবা। এসব সমস্যার সমাধানে মানুষের প্রয়োজন।

আমি জানি, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও স্টেম (সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথমেটিকস)-এর অনেক স্নাতক বর্তমান চাকরির বাজার দেখে হতাশ। এখন হয়তো অতীতের তুলনায় নতুন গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরির সুযোগ কম, কিন্তু এটা বদলে যাবে। চাকরির বাজার চক্রাকারে চলে—কয়েক বছর অন্য বছরের তুলনায় অনেক ভালো হয়। কিন্তু যেসব বছরে বাজারের পরিস্থিতি কঠিন থাকে, শিক্ষার্থীদের উচিত সেই সময়ে নিজের জ্ঞান আরও গভীর করা—নিজেদের স্বার্থে না হলেও, সমাজের স্বার্থে।

আমরা নতুন প্রজন্মের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ছাড়া নতুন সিস্টেম তৈরি চালিয়ে যেতে পারব না। আর আমাদের হাতে সমস্যার সংখ্যা বেশি, সেই তুলনায় মানুষ কম। একটি ভালো সমাজ গড়ে তোলার জন্য হলেও আমাদের আগামী প্রজন্মের কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের ভীষণ প্রয়োজন।