লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সহযোগী অধ্যাপক কেয়ু জিন। জনপ্রিয় বক্তৃতার মঞ্চ ‘টেড টক’–এ গত জুনে নিচের বক্তৃতাটা দিয়েছেন এই চীনা অর্থনীতিবিদ।

১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে আমার যখন জন্ম, তখনো অভাবী এক দেশ চীন। রেশনের খাবার খেতাম। এমনকি বেইজিংয়েও সপ্তাহে তিন দিন রাতে বিদ্যুৎ থাকত না। মনে পড়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে বাবা আমাকে কবিতা পড়ে শোনাতেন। সেই অভাবী সময়েও এই স্মৃতিটা আমার খুব প্রিয়।
প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে চীন এখন অনেক এগিয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক ও দৈনন্দিন প্রযুক্তি, সব আছে হাতের কাছে। এখন আমি আমার মুখ স্ক্যান করে একটা কোমল পানীয় কিনে ফেলতে পারি। মনে আছে, কয়েক বছর আগে এক হোটেলে উঠেছিলাম। সেখানে আমাকে টুথপেস্ট দিয়ে গিয়েছিল একটা রোবট। তিব্বতের পাহাড়ের দুর্গম রাস্তায় দেখেছি, সেখানকার বাসিন্দারা সৌরচালিত ওয়াকম্যানে গান শুনতে শুনতে হেঁটে যাচ্ছে। আফ্রিকার শিশুদের ঘরেও পৌঁছে গেছে চীনা সৌরপ্রযুক্তি। যে শিশুরা কয়েক দিন আগেও মোমবাতির আলোয় পড়ত, ঠিক আমার মতো।
যদিও চীন এখনো উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ১০ হাজার ডলার, তবু এসব অসাধারণ উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। আজকে আমি আপনাদের একটু অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে বলব।
চীনা প্রযুক্তি যেখানে আলাদা
আমি একজন অর্থনীতিবিদ। আমার এক পা লন্ডনে, সেখানে আমি গবেষণা করি; আরেক পা চীনে, সেখানে আমার পরিবার থাকে, কিছু কাজও করি। যদি আরেকটা পা থাকত, বলতাম আমার তৃতীয় পা-টা যুক্তরাষ্ট্রে। যেখানে আমি পড়ালেখা করেছি। অতএব চীনকে নিয়ে কেন এত ভুল–বোঝাবুঝি, সেটা আমি ভালোই বুঝি।
চীন কীভাবে উদ্ভাবন করে, সেটা দিয়ে শুরু করা যাক। উদ্ভাবন মানে শুধু আবিষ্কার করা নয়। যেমন আইফোন, থ্রিডি প্রিন্টিং কিংবা মঙ্গলে মানুষ পাঠানো। এটা হতে পারে নতুন ধরনের প্রয়োগ, নতুন ব্যবসায়িক মডেল, যা কিনা কম খরচে ভালো কাজ করবে।
টিকটক হয়তো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ভিডিওনির্ভর প্রথম অ্যাপ নয়, কিন্তু এটা সারা বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষকে এক করেছে। চীনা বৈদ্যুতিক গাড়ির প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডিও প্রথম নয়, কিন্তু টেসলার দামের তুলনায় এটি অনেক সাশ্রয়ী। একইভাবে চীনা মুঠোফোন আইফোনের মতো চমকপ্রদ নয়, কিন্তু আফ্রিকার অনেক দেশে তাদের মার্কেট শেয়ার অর্ধেকের বেশি। এভাবেই চীনা প্রযুক্তি উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটা বড় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে, আর তা হলো উন্নত প্রযুক্তি হাতের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা।
জুগুয়ো পদ্ধতি
আপনি বলতে পারেন চীনের কাছে টাকা আছে, বাজার আছে, মেধা আছে, তথ্য আছে, আর কী লাগে? কিন্তু আদতে তা নয়। চীনের সাফল্যের অন্যতম কারণ ‘জুগুয়ো’ পদ্ধতি, অর্থাৎ ‘পুরো জাতি’ এক হয়ে কাজ করা। একটা ভাবনা বা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে ব্যবসায়িকভাবে সফল করতে হলে লাগে উদ্ভাবন উপযোগী অনুকূল পরিবেশ। বিশ্ববিদ্যালয়, দেশের গবেষণাগার ও শিল্পকারখানা, বিনিয়োগকারী, সবার পারস্পরিক সহযোগিতাতেই এটা সম্ভব হয়েছে।
‘জুগুয়ো’ পদ্ধতি মানে হলো পুরো জাতি একটি কৌশলগত লক্ষ্যের পেছনে কাজ করা। দেশের সম্পদ কাজে লাগানো, পরিসর বড় করা এবং খরচের হিসাব রাখা। অলিম্পিকে যত বেশি সম্ভব স্বর্ণপদক জয়ের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছে চীন।
মেয়র অর্থনীতি
মাঠপর্যায়ে আরও একটা ব্যাপার আছে, আমরা একে বলি ‘মেয়র অর্থনীতি’। এটি হলো অর্থনীতিকে বিকেন্দ্রীকরণ করার একটি প্রক্রিয়া। উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। চীনের শীর্ষস্থানীয় তিন বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের একটি হলো নিও। বেইজিং ও সাংহাইজুড়ে নিওর গাড়ি আপনার চোখে পড়বে। অথচ কয়েক বছর আগে দেউলিয়া হতে বসেছিল এই প্রতিষ্ঠান। পূর্ব চীনে একটা ছোট্ট শহর আছে, নাম হেফেই। জনসংখ্যা ৫০ লাখের কাছাকাছি। তো সেখানকার স্থানীয় সরকার নিওকে প্রস্তাব দিল, প্রতিষ্ঠানটির সদর দপ্তর হেফেইতে স্থানান্তর করতে। ২৫ শতাংশ শেয়ারের জন্য সেখানকার সরকার তখন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল। নিওর জন্য আরও ঋণের ব্যবস্থা করেছে, প্রতিষ্ঠান ঘিরে একটা সাপ্লাই চেইন গড়ে তুলেছে। ফলাফল? মাত্র এক বছরে নিওর উৎপাদন বেড়ে গেছে ৮১ শতাংশ, বাজার মূলধনও ৪ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। এক বছরের মধ্যে হেফেই সরকারের টাকা উঠে এসেছে, নিওরও জীবন বেঁচেছে। এভাবে প্রত্যেক নিওর পেছনেই একটি স্থানীয় সরকার আছে। সম্ভাবনাময় কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করার জন্য সেই স্থানীয় সরকার পাহাড় সরাতেও রাজি। (সংক্ষেপিত)