ফ্যাশন ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত
ফ্যাশন ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত

হতে চেয়েছিলেন স্থপতি, হয়ে গেলেন ডিজাইনার

প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩২ সনেও দেশের ক্রীড়া, অভিনয়, গবেষণা, স্থাপত্যসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। একঝাঁক উজ্জ্বল তরুণকে নিয়ে দুই পাতার আয়োজন থেকে পড়ুন ফ্যাশন ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াতের গল্প।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলেন তাসমিত আফিয়াত। একদিন তাঁকে স্টাইল গুরু নামে এনটিভির একটা রিয়েলিটি শোর বাছাইপর্বে নিয়ে গেলেন মা। লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের চেয়ে বয়সে বড়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দেখে ঘাবড়ে গেলেন তাসমিত। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য মাকে জোরাজুরি করতে লাগলেন। মা বললেন, ‘হেরে গেলে আমি তোমাকে নিয়ে যাব। তবে তোমাকে প্রতিযোগিতা ফেস করে যেতে হবে।’ ২০১১ সালের সেই দিন তাসমিতের মা যদি তাঁকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন, এই লেখার সূত্রপাত তাহলে হয়তো হতো না!

বিচারকেরা তাসমিতকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘হোয়াট ইজ ফ্যাশন?’ উত্তরে তাসমিত তেমন কিছু না ভেবেই বলেছিলেন, ‘ফ্যাশন ইজ হোয়াট ইউ সি ইন মি।’ বিচারকেরা যেন এই উত্তরেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁরা দাঁড়িয়ে গেলেন, হাততালি দিলেন। এই প্রতিযোগিতায় মাত্র ২ ঘণ্টার ভেতর বিভিন্ন কনসেপ্টে পোশাকের ডিজাইন করে, বানিয়ে তা মডেলকে পরিয়ে র‍্যাম্পে উপস্থাপন করতে হয়েছিল। পরপর বেশ কয়েক দিন প্রতিযোগীদের ভেতর সেরা হয়েছিলেন সবার ছোট তাসমিত।

এক যুগ ধরে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে কাজ করছেন তাসমিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে ভর্তি হলে তা মেনে নিতে পারেননি তাঁর বাবা। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার রাস্তায় না গিয়ে চারুকলায় ভর্তি হওয়ায় কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন বাবা। তাসমিতেরও জিদ হলো। বাবার কাছ থেকে টাকা নেওয়াই বন্ধ করে দিলেন। ২০১২ সাল থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলা শুরু করল তাসমিতের ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘স্ট্রাইড’। করপোরেট চাকরিও করা শুরু করলেন। সেই সঙ্গে ফ্রিল্যান্সিং। সমান্তরালে পড়াশোনাটাও চলছিল।

কীভাবে সম্ভব? উত্তরে তাসমিত বললেন, ‘এত ছুটে বেড়াতাম আর দৌড়াদৌড়ি করতাম যে মাঝেমধ্যে আমাকে স্যালাইন দিয়ে রাখতে হতো। আমার সহপাঠী বা শিক্ষক অথবা আমাকে যাঁরা চেনেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। কেউ কেউ হয়তো বলবে আমি রুড (রূঢ়), তবে সে-ও সাক্ষ্য দেবে যে আমি কোনো দিন কারও সঙ্গে দশটা মিনিট আড্ডা দিইনি। আমার কোনো বন্ধু ছিল না। কাজই ছিল আমার বন্ধু। ঘুম থেকে উঠে ক্লাসে গেছি। ক্লাস থেকে বের হয়ে অফিস। অফিস থেকে বাসা। কোনো রকমে দুটো খেয়ে ঘুম। আমি এত পরিশ্রম করতাম যে এশিয়াটিকে আমার বস ইরেশ যাকের মজা করে বলতেন, “এত টাকা দিয়ে কী করবা?”’

তাসমিত আরও যোগ করলেন, ‘আসলে পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল কাজের কোনো বিকল্প নেই। তখনই পড়াশোনাটা পোক্ত হয়। আমার সেটা হয়েছিল। তৃতীয় বর্ষে অ্যানিমেশন শেখানোর আগেই আমি অফিসে অ্যানিমেশনের কাজ করতাম!’

রিকশাচিত্রের পোশাকে তাসমিত আফিয়াত

এসবের মাঝেই রুবাইয়াত হোসেন পরিচালিত আন্ডার কনস্ট্রাকশন সিনেমায় পোশাক নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন অর্ধশতাধিক টিভিসি বা টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনে। জনপ্রিয় মার্কিন রিয়েলিটি শো দ্য অ্যামেজিং রেস–এ অংশ নেন। মিস ইউনিভার্স, মিস ওয়ার্ল্ড, মিস্টার ওয়ার্ল্ডের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ‘জাতীয় পোশাক’ বিভাগে পোশাক বানাতে শুরু করেন। খেঁটে খুঁটে একেকটা বিশেষ কনসেপ্ট নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার বিষয়ে রীতিমতো ‘বিশেষজ্ঞ’ হয়ে গেলেন তাসমিত।

আর্কা ফ্যাশন উইকে তাঁর সংগ্রহ ‘সোশ্যাল সাইলেন্সিং’ নজর কেড়েছে এ বছর। সম্প্রতি বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবল জাতীয় দলের অ্যাওয়ে জার্সির নকশা করেছেন। ইতিমধ্যে হামজা-জামালদের হোম জার্সির নকশাও জমা দিয়েছেন। তাসমিতের নকশা করা জার্সি গায়ে চাপিয়ে তাঁরা এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরে খেলে এসেছেন। ১০ জুন ঘরের মাঠে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে খেলবেন। চুপিচুপি জানিয়ে রাখি, এই হোম জার্সিতে নাকি জামদানির মোটিফ থাকছে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, জার্সিতে জামদানি!

প্রথা ভেঙে, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একজন নারীর পেশাজীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ নয়। তাসমিত তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। জীবনে কেবল নিজের পছন্দমতো পোশাক পরার জন্যই চরিত্র নিয়ে গালি শুনেছেন উঠতে–বসতে। সেগুলোকে জড়ো করে তাসমিত রিকশা প্রিন্টে পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমার পোস্টার থিমে একটি জ্যাকেট বানিয়েছেন। সেটি বিক্রিও হচ্ছে হু হু করে!

তাসমিতের ব্যক্তিজীবনের গল্পটাও কম রোমাঞ্চকর নয়। একদিন রাতের বেলা হঠাৎ করেই গুলশানে তাঁকে দেখেন এক তরুণ মার্কিন কূটনীতিক। প্রথম দেখাতেই তাসমিতকে তাঁর ভালো লেগে যায়। কিন্তু তাসমিতকে টলানো যায় না। বন্ধুদের অনুরোধে দেখা করলেন। কথা বললেন। ভালো লাগল। হৃদয়বীণার তারে ঝংকার উঠল। তারপর পরিবারের পূর্ণ সম্মতিতেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন সেই তরুণ সাবিন হিন্টনের সঙ্গে। সেই বিয়েও হয়েছে খবরের শিরোনাম।

ছোটবেলা থেকেই ভালো আঁকাআঁকি করতেন তাসমিত। বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে পড়ার ইচ্ছা ছিল। সেটা পূরণ না হওয়ায় অনেক আফসোস ছিল। এদিন সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বললেন, ‘ভাগ্যিস, বুয়েটে চান্স পাইনি। জীবনে আসলে যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। অনেক পরে গিয়ে আমরা সেটা বুঝতে পারি। বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেলে আমি হয়তো মোটামুটি মানের স্থপতি হতাম। কোনো রকম একটা চাকরি করে জীবন কাটিয়ে দিতাম। তাহলে আজ আপনি আমার সাক্ষাৎকার নিতেন না। আর এই লেখাটাও ছাপা হতো না!’

শেখ সাইফুর রহমান: ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল পোর্টাল ‘হাল ফ্যাশন’–এর পরামর্শক