প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান ফ্লেক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রেভাথি অ্যাডভাইথি। ক্যানসার–আক্রান্ত অবস্থায়ও নিয়মিত অফিসের কাজ চালিয়ে গেছেন তিনি। কেন? সে কথাই টাইম ডটকমে লিখেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই মার্কিন প্রকৌশলী

ব্যাগ গোছানো, সারা দিন মিটিং করা, তারপর বিমানে ওঠা—সিইও হিসেবে এটাই ছিল আমার চেনা রুটিন। তবে সেদিন যাচ্ছিলাম ভারতে, মাকে দেখতে। এরপর আরও কিছু এশীয় দেশে ব্যবসায়িক সফর আর বন্ধুদের সঙ্গে বার্ষিক ভ্রমণের পরিকল্পনা ছিল; কিন্তু বিমানের আসনে বসেই হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে কেমন একটা চাকা অনুভব করলাম।
মাথায় হাজারটা চিন্তা খেলে গেল। যদি আশঙ্কা সত্যি হয়, তাহলে কী করব? পরের কয়েকটা দিন কেটে গেল ঝড়ের মতো—ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তার দেখানো, অনেক টেস্ট আর নির্ঘুম রাত। খুব শিগগির আমি সে কথাটি শুনলাম, যা কেউ কোনো দিন শুনতে চান না, ‘আমরা দুঃখিত। আপনার স্তন ক্যানসার হয়েছে।’
সেই মুহূর্তে মনে হলো পৃথিবী থেমে গেছে।
বিশ্বজুড়ে প্রতি পাঁচজনে একজন জীবদ্দশায় ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এই রোগ কোনো সীমানা মানে না, কোনো পদবি মানে না। আপনি ব্যবসা করছেন, পরিবার সামলাচ্ছেন বা অবসর নিয়েছেন—ক্যানসারের কাছে এর কোনো গুরুত্ব নেই। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছেন, যাঁদের জীবনে কোনো না কোনোভাবে এই রোগ ছায়া ফেলেনি। এমন খবর শোনার পর মনে হয়, সময়টা থেমে যাওয়া উচিত। অথচ পৃথিবী চলতে থাকে আপন নিয়মে।
জানতাম, এক অজানা পথে পা বাড়াচ্ছি। পরিবার আমাকে মনে করিয়ে দিল, আগেও বহুবার অজানা পথে হেঁটেছি। যখন ফ্লেক্সের সিইও হলাম, তখন দ্রুত শিখতে হয়েছিল, চ্যালেঞ্জ ও সুযোগগুলো বুঝে কোম্পানির জন্য সঠিক পথ নির্ধারণ করতে হয়েছিল। এবারও একইভাবে শিখতে হলো। নিজের ক্যানসার সম্পর্কে জানতে হলো, চিকিৎসার সম্ভাব্য সব উপায় খুঁজতে হলো; আর চিকিৎসক দলের সঙ্গে মিলে সর্বোত্তম পথ ঠিক করতে হলো।
কিন্তু তবুও এই অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম। কয়েক দিন গভীর অন্ধকারে থাকার পর নিজেকে টেনে তুললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম—আমি কাজ চালিয়ে যাব।
এই সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। চেয়েছিলাম, পৃথিবী যেমন চলছে তেমনই চলুক। আমি চাইনি ক্যানসার আমার জীবন পাল্টে দিক। বুঝতে পারছিলাম, চিকিৎসা ও সুস্থতার একটি বড় অংশ জীবনের সব দিকের সঙ্গে যুক্ত থাকা। তার মানে, যা ভালোবাসি, যা আমাকে অনুপ্রাণিত করে, সেগুলো করে যাওয়া।
আমার জীবনদর্শন সব সময়ই সামগ্রিকভাবে বাঁচা। নিজেকে ভাগ করে আলাদা আলাদা খোপে রাখাটা কখনো অর্থপূর্ণ মনে হয়নি। পরিবার, বন্ধু, কাজ, ব্যক্তিগত লক্ষ্য—সবই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা জীবনের একেকটি অংশ। এসবই আমাকে উদ্দেশ্য, স্থিতি ও স্বাভাবিকতার অনুভূতি দেয়। বিশেষ করে যখন চারপাশ অস্থির লাগে, এই সম্পর্কগুলোই আমাকে মাটিতে রাখে।
শুরু হলো কঠিন এক বছর—হাসপাতালে অন্তহীন যাতায়াত, কেমোথেরাপি, সার্জারি। কখনো কখনো মনে হতো, এসব ভূমিকা একসঙ্গে সামলানো অসম্ভব। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই এবং সিইও থাকা—দুটিই আলাদাভাবে ভীষণ কঠিন, একসঙ্গে তো আরও বেশি। মনে আছে, এক শুক্রবার কেমোথেরাপি দেওয়ালাম। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ্য করার পাশাপাশি তখন আমাকে পরের বুধবারের জরুরি মিটিংয়ের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছিল।
একজন নেতা হিসেবে নিজের অঙ্গীকার রক্ষা এবং দলের গতি ধরে রাখা—এটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু এর বাইরেও আরেকটা জেদ ছিল। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম, ক্যানসারকে আমার সীমা নির্ধারণ করতে দেব না। আমাদের পরিশ্রমে গড়ে তোলা স্বপ্ন যেন থেমে না যায়, সেই লড়াই চালিয়ে যাব।
স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ ছিল ঠিক, তবু সেই সময়টা ছিল একরকম রোমাঞ্চপূর্ণ। দলের অক্লান্ত পরিশ্রম, সহনশীলতা ও সাফল্যের ধারাবাহিকতা দেখে আমার গর্ব হচ্ছিল। কর্মীদের এই অদম্য প্রতিশ্রুতি আরও শক্তি দিয়েছিল। মনে মনে ভাবছিলাম—আমি সেই নেতা হব, যে নেতা তাঁদের প্রাপ্য। আমি ক্যানসারকে হারাব।
সত্যি বলতে, এমন অনেক দিন গেছে যখন মানুষ আমাকে ‘শক্তিশালী’, ‘যোদ্ধা’, ‘লড়াকু’ ইত্যাদি বলতেন। অথচ এসবই আমার কাছে অর্থহীন লাগত। কেমোথেরাপি এক কঠিন চিকিৎসা, যেটার জন্য দৃঢ় মানসিক ও শারীরিক শক্তি লাগে।
এই যাত্রাপথে উপলব্ধি করেছিলাম, ‘কেন আমার সঙ্গেই এটা ঘটল?’—এই প্রশ্নের কোনো মানে নেই; বরং ভাবতে পারি, ‘কেন আমার সঙ্গেই ঘটবে না?’ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি আটজন নারীর মধ্যে একজন জীবদ্দশায় স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তাঁদের বেশির ভাগই সন্তান, কাজ ও কঠিন চিকিৎসা—সব একসঙ্গে সামলাচ্ছেন। সেই অসাধারণ নারীদের তুলনায় আমার লড়াই তো অনেক সহজ।
অন্যদের মতো আমি ততটা দুর্ভাগা নই। আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা আর স্ট্যানফোর্ড হাসপাতালের অসাধারণ চিকিৎসক দলের কারণে সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যানসারমুক্ত হয়েছি। এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যা প্রয়োজন, সেগুলো হাতে ছিল—এটা এক বিশাল প্রাপ্তি।
আরোগ্যের পথে আমাকে ঘিরে থাকা অগাধ ভালোবাসার কথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে। আমার পরিচয়ের সঙ্গে ‘ক্যানসারজয়ী’ যোগ হওয়ার পর থেকে জীবন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। কৃতজ্ঞতার নতুন পাঠ শিখেছি। এটা আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় করেছে; আমাদের জীবনে আমরা পূর্ণ মানুষ হিসেবেই হাজির হই— একজন স্ত্রী, মা, মেয়ে, বোন, বন্ধু ও নেতা। ক্যানসার–সহায়তা গ্রুপগুলো আমাকে শিখিয়েছে, কীভাবে অন্যদের লড়াই থেকে শক্তি আর সহনশীলতা অর্জন করা যায়। এখন আমার ভেতরে নতুন করে আগ্রহ জেগেছে—যাঁরা চিকিৎসার কঠিন পথ পাড়ি দিচ্ছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর। কাউকে সহায়তা করার, তাঁর জন্য বাঁচার আশ্রয় হয়ে ওঠার বহু উপায় আছে।
পেছন ফিরে তাকালে দেখি, আমার ক্যানসারের লড়াই ও সুস্থতার পথ আমাকে নেতা হিসেবে দুর্বল করেনি; বরং আরও দৃঢ় করেছে। দিয়েছে কৃতজ্ঞতা, উদ্দেশ্য আর সম্ভাবনায় ভরা এক অধ্যায় শুরু করার সাহস। কেমোথেরাপি আমার চুলের স্টাইল বদলে দিয়েছে; কিন্তু নতুন চুলের সঙ্গে এসেছে নতুন আমি। আমি শিখেছি, যখন পৃথিবী থেমে থাকে না, তখন নিজের সেরা পথে এগিয়ে চলা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।