মশা থেকে শুরু করে ক্যাপসিকাম, নানা বিষয়ে গবেষণা হয় সিলেটের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে

বয়সের হিসাবে এখনো ‘টিনএজ’ পেরোয়নি। এর মধ্যেই নানা গবেষণার সূত্রে দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ায় এমনিতেই সব শিক্ষার্থীর এখানে গবেষণায় যুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক। এসব গবেষণার কোনো কোনোটা থেকে এসেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণার খোঁজ নিয়েছেন সুমনকুমার দাশ

মশা নিধন হবে, পরিবেশও বাঁচবে

অ্যানিমেল অ্যান্ড ফিশ বায়োটেকনোলজি বিভাগের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র নুরুল আমিন। স্নাতকে সিজিপিএ ৩ দশমিক ৮১ পেয়ে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার হাজারী চকগ্রামে। ব্যবসায়ী বাবা ও গৃহিণী মায়ের দুই ছেলের মধ্যে তিনি ছোট। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের তত্ত্বাবধানে তিনি রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে মশকনিধনের গবেষণা করেন।

রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে মশকনিধন নিয়ে গবেষণা করেন এই শিক্ষার্থীরা

নুরুল আমিন জানান, বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে সিঙ্গাপুর ডেইজির গুণাবলি চিহ্নিত করেছেন তাঁরা। উদ্ভিদটির পাতার নির্যাস সংগ্রহ করে এর ব্যাকটেরিয়া ও মশানাশক ক্ষমতা মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, উদ্ভিদের নির্যাস দিয়েও কার্যকরভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

গবেষণাটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন অ্যাডভান্স অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ২০২৪-এ পুরস্কারও পেয়েছে। নুরুল আমিন বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব, টেকসই ও প্রাকৃতিক মশা নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য, যাতে প্রকৃতির সমস্যা সমাধান আমরা প্রকৃতির উপাদান দিয়েই করতে পারি। এ গবেষণা বাংলাদেশসহ মশাবাহিত রোগপ্রবণ নানান অঞ্চলে রাসায়নিক নির্ভরতা কমিয়ে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’

একই বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র তানজিন বরকতউল্লাহও মশকনিধন নিয়ে আরেকটি গবেষণা শেষ করেছেন। তাঁরও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক কাজী মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। সিলেট অঞ্চলের মাটি থেকে তানজিন কিছু ব্যাকটেরিয়া আলাদা করেছেন। এসব ব্যাকটেরিয়া মশকনিধনে বেশ কার্যকর বলে তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে। তানজিন জানান, ব্যাকটেরিয়ার চারটি আইসোলেটের মধ্যে মশাবিনাশী টক্সিন জিন পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়ার নাম লাইসিনিবেসিলাস, যা শুধু মশাকেই আক্রমণ করে। অন্যান্য উপকারী পোকামাকড় ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না।

তানজিন আরও বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধানত বিটি (বেসিলাস থুরিঞ্জিয়েনসিস) ব্যবহার করা হয়, যা আমদানি হয় সিঙ্গাপুর থেকে। এটি ব্যয়বহুল। তা ছাড়া এই উপাদান বড় পরিসরে অন্য অনেক পোকামাকড়কেও আক্রমণ করে। কিন্তু লাইসিনিবেসিলাস নির্দিষ্টভাবে শুধু মশাকে টার্গেট করে, তাই এটি নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব। আধুনিক মলিকুলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো শনাক্ত করেছি। এরপর বায়ো-এফিকেসি (জৈব কার্যকারিতা) পরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছি, মশার লার্ভা নিধনে এগুলো খুবই কার্যকর।’

তানজিন বরকতউল্লাহর বাড়ি ময়মনসিংহ সদরের আকুয়া এলাকায়। তিনি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে গবেষণা শুরু করে ২০২৪ সালের মে মাসে শেষ করেন। এ গবেষণা এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। ন্যাশনাল থিসিস প্রতিযোগিতায় নেটওয়ার্ক অব ইয়াং বায়োটেকনোলজিস্ট বাংলাদেশ থেকে বায়োটেকনোলজি ক্যাটাগরিতে পেয়েছে দ্বিতীয় স্থান। এ ছাড়া বেস্ট ওরাল প্রেজেন্টেশন হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব অ্যাডভান্স অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ২০২৪-এ গবেষণাটি মনোনীত হয়েছে।

তানজিন বরকতউল্লাহ বলেন, ‘দেশীয় মাটিতে উৎপাদিত এই ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করলে সিঙ্গাপুর থেকে বিটি আমদানির প্রয়োজন পড়বে না, যা আমাদের কোটি টাকা সাশ্রয় করবে। এ উদ্ভাবন নতুন পথ দেখাবে, মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় ও টেকসই সমাধান উপস্থাপন করবে। আমাদের লক্ষ্য হলো একটি পরিবেশবান্ধব সমাধান, যাতে ক্ষতিকর রাসায়নিক থেকে মুক্তি পায় বাংলাদেশ এবং পুরো বিশ্বের মানুষ। পাশাপাশি আমরা ভেক্টরবাহিত রোগগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই, যাতে মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।’

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদ আছে। প্রতিটি অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দেশি-বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পের অধীন প্রায়োগিক গবেষণা চলমান। শিক্ষার্থীরা তাঁদের মেধা ও যোগ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ সব গবেষণা সম্পন্ন করে দেশ-বিদেশে প্রশংসিতও হচ্ছেন। কৃষি গবেষণায় বড় অবদান রাখছেন আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আমরা তাঁদের নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি।
মো. আলিমুল ইসলাম, উপাচার্য, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সারা বছরই ক্যাপসিকাম চাষ

ইদানীং সারা বছরই বাজারে ক্যাপসিকাম চোখে পড়ে। তবে রঙিন এই সবজির ফলন ভালো হয় মূলত শীতকালে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর গবেষণা সারা বছরই ক্যাপসিকামের উচ্চফলনের সম্ভাবনা জাগাচ্ছে। উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান জান্নাতুল ফেরদৌসের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি করছেন স্নাতকোত্তরের দুই শিক্ষার্থী মির্জা সাদী সালমান ও তাহমিদ বিন শাহাব। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি প্রকল্পের আওতায় এ গবেষণা চলছে।

গবেষকদের দাবি, কলমপদ্ধতিতে কৃষকেরা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সারা বছর ক্যাপসিকামের চাষাবাদ করতে পারবেন।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, ব্যাকটেরিয়ার কারণে ক্যাপসিকামগাছ গ্রীষ্মকালে নেতিয়ে পড়ে। এটা প্রতিরোধে কলমপদ্ধতি ব্যবহার করে সাফল্য পেয়েছেন তাঁরা। গবেষকদের দাবি, কলমপদ্ধতিতে কৃষকেরা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সারা বছর ক্যাপসিকামের চাষাবাদ করতে পারবেন। ক্যাপসিকামের ২১টি ভ্যারাইটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি সিলেটের মাটির জন্য কোন প্রজাতির ক্যাপসিকাম উপযোগী, সেটা নির্ধারণেও এখন তাঁদের কাজ চলছে।

উচ্চফলনশীল শর্ষের জাত

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌলিতত্ত্ব¡ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক দিলারা আক্তারের তত্ত্বাবধানে উচ্চফলনশীল শর্ষের জাত উদ্ভাবন করেছেন ছয় শিক্ষার্থী। গবেষকদলে থাকা শিক্ষার্থীরা হলেন স্নাতকোত্তরের আবু তালহা, তনয় পাল, এস এম সাদ এবং স্নাতক চতুর্থ বর্ষের রাহনুমা নুরাইন, তাসপিয়া জাহান ও তনুশ্রী শীল। তাঁরা জানালেন, তাঁদের উদ্ভাবিত শর্ষে সাধারণ দেশীয় শর্ষের চেয়ে বেশি তেল উৎপাদন করতে সক্ষম। তা ছাড়া এর পাতা সবজি হিসেবে খাওয়া যাবে।

প্রথমে বিদেশ থেকে শর্ষের ১২ ধরনের জাত সংগ্রহ করে গবেষকদল। এর মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে ৩টিকে বাছাই করা হয়। পরে একটি জাতকে সিলেট অঞ্চলের মাটির উপযোগী হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সাধারণত শর্ষেগাছে ২০ থেকে ৩০ গ্রাম পাতা থাকে। কিন্তু এই শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবিত শর্ষেগাছ থেকে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ কেজি পাতা সংগ্রহ করা যাবে। এসব গাছের উচ্চতা হবে ৮ থেকে ১০ ফুট। পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পর্যায়ে উচ্চফলনশীল এ জাতের শর্ষে চাষ করার পরিকল্পনা চলছে এখন।

গবেষকেরা তাঁদের উদ্ভাবিত শর্ষেগাছকে ‘জিরো ওয়েস্টেজ’ হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ গাছের প্রতিটি উপকরণ তাঁরা কাজে লাগাতে উৎসাহিত করবেন। মানুষের খাদ্যের পাশাপাশি গোখাদ্য হিসেবেও শর্ষেগাছকে ব্যবহার করা যাবে, বলছেন তাঁরা। শর্ষে ও পাতা খাবার হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি উৎপাদন শেষে গাছ যেন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, এতেও গবেষকদল কৃষকদের উৎসাহিত করবে।

গবেষকদলের সদস্যরা জানান, সাধারণত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শর্ষের উৎপাদন হয়। কম সময়ে কীভাবে এ ফসলের চাষ করে বেশি লাভ করা যায়, তা নিয়েও কাজ করছেন তাঁরা। এ ছাড়া সুপারফুডখ্যাত কিনোয়ার একাধিক জেনেটিক লাইন নিয়েও তাঁরা কাজ করছেন বলে জানালেন।