মস্কোর রানওয়ে মনে করাল তাঁদের গৌরবময় ফ্যাশনের কথা

রাশিয়ার নবীন ডিজাইনারদের কাজ নজর কাড়ে
মস্কো ফ্যাশন উইকের সৌজন্যে

একটার পর একটা ফ্যাশন শো শেষ হচ্ছে আর ভাবছি, শীতপ্রধান একটি দেশ অথচ পোশাকে কত বৈচিত্র্য! কোট, ওভারকোট ছাড়াও কত ধরনের পোশাক। বিশেষ করে লেয়ারিং পোশাক। মডেলদের গায়ে একটার ওপর আরেকটা পোশাক চাপানোও হয়েছে খুব দৃষ্টিনন্দন করে। গত মার্চে সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রের রাজধানীতে বসে দেখলাম বিশ্ব ফ্যাশনে তাদের উপস্থিতি।

১৩ থেকে ১৮ মার্চ মস্কোর ঐতিহ্যবাহী ভবন মানেজের সেন্ট্রাল এক্সিবিশন হলে বসেছিল মস্কো ফ্যাশন উইক। যেখানে রাশিয়ার নবীন-প্রবীণ ডিজাইনার ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডিজাইনারদের পোশাক প্রদর্শিত হয়। ছয় দিনে মোট ৯০টি ফ্যাশন কিউ। বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো ছিল রাশিয়ার নতুন ডিজাইনারদের কাজ।

অ্যাডিকটেড টু ব্র্যান্ডের শীতের পোশাক

রাশিয়ার ফ্যাশন ঐতিহ্য

ফ্যাশনপ্রেমীদের অনেকেই হয়তো জানেন, রাশিয়ার এই শহরেই মিলেছে ফ্যাশন বিশ্বের এক অনন্য দলিল। মস্কোর কাছে সুঙ্গির অঞ্চলে ৩৪ হাজার বছর আগের এক সমাধিস্থলে পাওয়া গেছে একজন পুরুষ এবং দুটি শিশুর সমাধি। তাদের দেহাবশেষের কাছেই ছিল ম্যামথের দাঁত থেকে বানানো হাজার হাজার পুঁতি। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ ইয়ান গিলিগান তাঁর গবেষণাপত্রে জানাচ্ছেন, এসব পুঁতি এমনভাবে সাজানো ছিল যে অনায়াসেই বোঝা যায়, সেসব জামা, হাতার অংশ ও প্যান্টের ওপর সেলাই করা ছিল। এই আলামত প্রমাণ করে, শুধু আজকেই না, আদিকালের রাশিয়ান সমাজেও স্টাইলিশ পোশাক বানানো গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পাশাপাশি এই দেহাবশেষ আরেকটি বিরল প্রমাণ তুলে ধরে, প্রাচীন যুগের সেসব মানুষ শুধু গা গরম রাখার জন্য নয়, বরং পোশাককে সুন্দর করার পেছনেও সময় এবং শ্রম দিতেন।

পৃথিবীতে সবচেয়ে পুরোনো যে পোশাকের নমুনা বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন, তার বয়স মাত্র ১০ হাজার বছর। তার মানে কী এর আগে মানুষ পোশাক পরত না? ‘অবশ্যই পরত’ বলে দাবি করছেন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। পোশাক টেকসই নয়, তাই কালক্রমে সেটা নষ্ট হবেই। যে কারণে এর চেয়ে পুরোনো পোশাক সংগ্রহ করা হয়তো এখনো সম্ভব হয়নি। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের আবিষ্কার করা প্রাচীন ভেনাসের মূর্তি প্রমাণ করছে মানুষের পোশাক পরার অভ্যাস আরও বহু বছর আগের। সেখানেও ঘুরেফিরে আসতে হবে রাশিয়ার কাছে।

রাফেলের ব্যবহার দেখা গেছে

রোমান সভ্যতারও হাজার হাজার বছর আগে রাশিয়ায় এমন সব মূর্তি নির্মাণ করা হয়েছিল, যাকে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ভেনাস নামে ডাকেন। ইউরোপের কয়েকটি অঞ্চল ছাড়াও রাশিয়ার সাইবেরীয় অঞ্চলে এমন কিছু নারী মূর্তি পাওয়া যায়। রাশিয়ায় পাওয়া ভেনাসের নাম কস্তেনকি। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ হাজার থেকে ২০ হাজার বছর আগের এই কস্তেনকি ভেনাসের গায়েও মিলেছে পোশাকের প্রমাণ। ফিতায় মোড়ানো এই পোশাক দেখেও বোঝা যায়, রাশিয়ার ফ্যাশন ঐতিহ্য কতটা পুরোনো। বিশেষ করে প্রস্তরযুগের নারীরা কী পরতেন, তারও একটা ধারণা মেলে সেখানে।

এসব তো গেল কেতাবি তথ্য, নিজ চোখে যা দেখা গেল, সেসবও কম পুরোনো নয়। বিশেষ করে রাশিয়ার বলশয় থিয়েটারের জাদুঘরে দেখলাম এমন কিছু প্রাচীন পোশাক ও পোশাকের স্কেচ যা ১০০ থেকে ১৫০ বছরের পুরোনো। ১৮২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই অপেরার একটি তলায় সংরক্ষিত আছে বিভিন্ন সময়ের অভিনেতাদের পরা বিখ্যাত কয়েকটি পোশাক। যেসব পোশাকের নকশা এখনো আধুনিক।

এ বছর ফ্যাশনে দেখা যাবে হলুদ রং

রানওয়েতে যা দেখা গেল

বলশয় থিয়েটার ঘুরে যে মুগ্ধতা নিয়ে বেরিয়েছিলাম, ফ্যাশন শোর দ্বিতীয় দিন সেই রেশ যেন ধরে রাখল এই প্রজন্মের রাশিয়ান ডিজাইনাররাও। বিকেলে রানওয়েতে জোটেমে, কিসিলিঙ্কো, এরমিলভ, পিরসিভের মতো ব্র্যান্ডের পোশাকগুলো দেখে তাই মনে হলো, পূর্বসূরিদের সবই যেন উত্তরসূরি হিসেবে পেয়েছেন তরুণ এই ডিজাইনাররা। কারও চেয়ে কারও ভাবনা কম নয়। কেউ পোশাকে সমকালীন ভাবনা ফুটিয়ে তুলেছেন, কেউবা প্রকৃতি নিয়ে ভেবেছেন। রঙের ভিন্নতা, প্রযুক্তির ভাবনা সবই যেন পোশাকের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে।

শার্ট, স্কার্ট, নানা রকম প্যান্ট, লম্বা জ্যাকেট, টপের ওপর লেয়ারিং করা শ্রাগ সবই দেখা গেল। রিভার্সিবল পোশাকও এনেছিলেন ডিজাইনারদের কেউ কেউ। রিভার্সিবল এমন পোশাক যার উল্টো-সোজা বলে কোনো কথা নেই, দুই পাশই গায়ে চাপানো যায়। আর এখন তো রিসাইকেল, আপসাইকেল নিয়ে অনেক আলোচনা, ডিজাইনারদের কাছ থেকে তেমন কিছু কাজও পাওয়া গেল।

স্লিট গাউন, নাইট গাউন, পার্টি ওয়্যার, বডি হাগিং ড্রেস, কোল্ড শোল্ডার বা অফ শোল্ডারেও অভিনব ভাবনার দেখা মিলল। ছেলেদের ফরমাল ওয়্যারের পাশাপাশি বেশি দেখা গেল স্ট্রিট ওয়্যার। ছিল খাটো প্যান্ট, বারগেন্ডি, জগার্স, টি-শার্ট, ব্লেজার, ওভারকোট। গরমকে মাথায় রেখেই তাদের সংগ্রহ সাজিয়েছেন বেশির ভাগ রাশিয়ান ডিজাইনার।

পোশাকে ক্রুশকাটার নকশা

আন্তর্জাতিক ডিজাইনারদের পোশাক

বাইরের যেসব দেশের ডিজাইনাররা আমন্ত্রিত হিসেবে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের সংগ্রহের বেশির ভাগই সেই দেশ বা অঞ্চলের সংস্কৃতিতেই তুলে ধরেছে। আর তাই বিভিন্ন অঞ্চলের ফ্যাশন–সংস্কৃতির মোটামুটি একটা ধারণাও মস্কো ফ্যাশন উইকে মিলেছে। ইন্ডিয়ান ফ্যাশন কাউন্সিলের পক্ষ থেকে ভারতীয় দুই ডিজাইনার অনিতা ও সামন্ত চৌহান তাঁদের সংগ্রহ তুলে ধরেন। ভারতের অন্যতম আবেগের জায়গা খাদির পোশাক ও মোগল, জারদৌসি মোটিফে লেহেঙ্গা, গাউনের মতো পোশাকও উপস্থাপন করেন তাঁরা। ইন্দোনেশিয়ার ডিজাইনার শুকরিয়া রুশদির ব্র্যান্ড রিবর্ন ২৯ রানওয়েতে উপস্থাপন করেন একটু লম্বা কাটের পোশাক। নানা রকম ফেব্রিক নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়েছেন রুশদি। তাঁর নকশায় উঠে এসেছে পেঁয়াজ ফুলের ভাবনা। ঢিলেঢালা পোশাক নিয়ে কাজ করেছে চীনা ব্র্যান্ড আই-লা। পার্টি গাউন ছাড়াও সেখানে জ্যাকেট, কোট ও সোয়েটারের দেখা মেলে।

ফ্যাশন বাজারে ছিল কেনাকাটার সুযোগ

স্প্যানিশ ব্র্যান্ড মিগুয়েল লোপিস তুলে ধরে গাউনের ভিন্নতা। অফ শোল্ডার গাউন, স্ট্র্যাপলেস গাউন, হল্টারনেক গাউন, বল গাউন, এ লাইন গাউন, মারমেইড শেপের গাউনসহ আরও নানা ধরন। কালো, মেরুন, ঘিয়ে রংকে প্রাধান্য দিয়ে পোশাকের সংগ্রহ সাজান এই স্প্যানিশ ডিজাইনার।

এই সময়ের তরুণ তুর্কিরা কোন ধরনের পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্য, সেটাই দেখিয়েছেন টার্কিশ ডিজাইনার এমরে এরডেমোগলু। চামড়ার তৈরি ফরমাল পোশাক দেখা গেল। এমরের পোশাকে চামড়া ছাড়াও ছিল মেটাল আর নেটের ব্যবহার।

আয়োজনের পঞ্চম দিনে সংগ্রহ নিয়ে এসেছিলেন তাজিকিস্তানের দুই ডিজাইনার ব্র্যান্ড সাফিয়া কতুর ও ইকাত হাউস। তাজিকিস্তানের ইসলামি ভাবধারার সঙ্গে ইউরোপের সংস্কৃতি মিশিয়ে নকশা করেছেন ডিজাইনাররা। পোশাকগুলোর কাপড় হিসেবে তাজিকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী প্রিন্ট আলাচা, সুজানি ও চাকান এমব্রয়ডারি দেখা যায়।

ঘিয়ে এবং চেরি রেড রঙের প্রাধান্য

আরও যত আয়োজন

ফ্যাশন শো ছাড়াও মানেজের কয়েকটি ফ্লোরে বসেছিল ফ্যাশন বাজার। মস্কো ফ্যাশন উইকে এবার অংশ নিয়েছে ১৮০টি ব্র্যান্ড, যার ১০০টি রাশিয়ার বিভিন্ন শহর থেকে এসেছে। ফ্যাশন বাজারে ব্র্যান্ডগুলো তাদের লাইফস্টাইল পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীরা যেখানে থেকে কেনাকাটা করেছেন পোশাক, গয়না, ব্যাগ, জুতা, সানগ্লাস, ঘড়ি, ঘর সাজানোর পণ্য, কারুপণ্য ইত্যাদি।

প্রতিদিন একাধিক সেশনে টেকসই ফ্যাশন নিয়ে কথা বলেছেন বিভিন্ন দেশের এক্সপার্টরা। ছিল আরও নানা আয়োজন। স্ট্রিট ফ্যাশন ফটোশুটে মডেলরা ছাড়াও সাধারণ মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো।

রাশিয়ার কালচারাল ফাউন্ডেশন অব ফ্যাশন অ্যান্ড ডিজাইন ডেভেলপমেন্টের আয়োজনে ‘মস্কো ফ্যাশন উইক’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রায় ২০ বছর। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ফ্যাশন উইক নিয়ে বাইরের দুনিয়ারও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।