
একসময় নীল চাষ ছিল কৃষকের বঞ্চনা ও নিপীড়নের গল্প। এখন সেটাই হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় উপকরণ। এই উপকরণ নিয়ে বাংলাদেশে যে কটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, তার মধ্যে ‘লিভিং ব্লু’ অন্যতম। চাষের মাধ্যমে পাওয়া রং দিয়ে তারা শাড়ি, স্কার্ফ, স্টোলসহ নানা ধরনের পণ্যে আনছে টাই–ডাইয়ের নকশা।
রাজেন্দ্রপুরে যখন পৌঁছালাম, রোদের তাপে চারদিক তখন ঝলসে যাচ্ছিল। কোনো দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল ছোট ছোট মাচা। তার ওপর পাতা ট্রেতে নীল রঙের গাদের দিকে তাকিয়ে চোখ যেন আরাম পেল।
এই আরাম মনকেও ছুঁয়ে গেল যখন নীল রঙের নকশা করা শাড়িগুলো দেখলাম। কারখানার একদিকে নীল পাতা জাগ দেওয়া হচ্ছে, আরেক পাশে বড় চুলায় নীল জ্বাল দিচ্ছেন কর্মীরা। আরেক দিকে গাদটাকে ট্রেতে করে রোদে শুকানো হচ্ছে।
চারদিকে চলছে পোশাকে প্রাকৃতিকভাবে টাই-ডাই করার প্রস্তুতি। গোছানো, ছিমছাম এই পরিবেশেই বানানো হচ্ছে অভিজাত নানা পণ্য।
বাংলাদেশে অনেক বছর ধরেই টাই-ডাই নিয়ে কাজ হচ্ছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সুনামও কুড়িয়েছে। ‘লিভিং ব্লু’ তাদের মধ্যে অন্যতম। ২০০৮ সালে কেয়ার বাংলাদেশের একটি প্রজেক্ট হিসেবে যাত্রা শুরু করে লিভিং ব্লু।
বর্তমানে এটি স্বতন্ত্র উদ্যোগ। রংপুরের রাজেন্দ্রপুরের গোয়ালপাড়া এলাকায় তাদের নিজস্ব কারখানাতেই তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক নীল রং।
একসময় এই নীল ছিল কৃষকের বঞ্চনা ও নিপীড়নের উৎস। সেটাই এখন হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় এক উপকরণ। তবে নীলের বাইরেও নানা রং ব্যবহার করে লিভিং ব্লু।
কারখানায় টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরের ভেতর রাখা বড় বড় ট্রাংকগুলো খুলতেই তার কিছু ঝলক দেখা গেল, যখন ‘নকশা’র ফটোশুটের জন্য নানা রঙের শাড়ি, স্কার্ফ, স্টোল, কাঁথা বের করছিলেন শিল্পীরা।
লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর এলাকার প্রায় ২০০ শিল্পী শুধু টাই-ডাইই নয়, বুনে চলেছেন নানা নকশার কাঁথা। রপ্তানি হচ্ছে ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়। জানা গেল কাঁথা, স্টোল, স্কার্ফ, পোশাক, শাল, টোট ব্যাগের পাশাপাশি নীলের কেক বা গুঁড়াও বিক্রি করা হয় নিয়মিত।
ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইতালি থেকে গ্রাহকেরা নিয়মিত কেক বা ডাস্ট আকারে কেনেন নীল। এ বছর এখন পর্যন্ত এক হাজার কেজি নীল বিক্রি হয়ে গেছে।
লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, দিনাজপুর এলাকার শিল্পীদের কাজের ভাগ করা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাঁথা স্টিচিংয়ের মধ্যে ‘সাদার ওপর সাদা’ কাঁথার কাজ দিনাজপুর এলাকায় করা হয়।
সেখানকার সাইতারা ইউনিয়নের শিল্পীরা এ কাজের জন্য বিখ্যাত। সাদা কাপড়ের ওপর কাজ করার জন্য তাঁরা বিশেষ ব্যবস্থা নেন, যাতে কোনো দাগ না পড়ে কাজ করার সময়। কাঁথার ওপর ডব্লিউ ডব্লিউ ডিজাইন ভালো করে লালমনিরহাটে।
রংপুরের শিল্পীরা আবার বহুমুখী। এখানে দাবার নকশা, শিবরির ডিজাইন, শাড়ির ওপর সব ধরনের কাঁথা স্টিচ করা হয়। এখান থেকে ফরমাশ দিয়ে পণ্য বানিয়ে নেন দেশীয় নামীদামি বেশ কিছু দোকান।
পণ্যের ওপর নকশাগুলো কীভাবে নির্ধারণ করেন? উত্তরে লিভিং ব্লুর চিফ কো-অর্ডিনেটর গোলাম রাব্বানী জানান, ‘লিভিং ব্লু যে পণ্যই বানায়, সেখানে বাংলাদেশ থাকে। বিশেষ করে দেশের বাইরের পণ্যগুলোতে ঐতিহ্যবাহী নকশার ওপর প্রাধান্য দিই আমরা। বেশির ভাগ সময় আমাদের দেওয়া নকশাই পছন্দ করেন বাইরের গ্রাহকেরা। কিছু সময় আমরা তাঁদের দেওয়া নকশার ওপর কাজ করি।’
কথা বলতে বলতেই বারান্দার এক কোণে বসা শিল্পীদের ওপর চোখ চলে যায়। পা ছড়িয়ে গুটগুট করে গল্প করতে করতে সুই-সুতায় ৩২ গজের সাদা কাঁথার ওপর ফুল, লতাপাতার নকশা ফোটাচ্ছিলেন তাঁরা। এ নকশা যে অনেক চিন্তাভাবনা করে সব সময় আসে, তা–ও নয়। কাজের অভিজ্ঞতায় হাতের টানেও চলে আসে অনেক সুন্দর নকশা।
লিভিং ব্লুর কাজের অনেক বড় একটা অংশজুড়ে থাকে নীল। তবে এই নীলের বাইরে আরও ১১টি রং নিয়ে তারা কাজ করে। মেরুন, সবুজ, কালো, লাল, কমলা, জলপাই, সোনালি, ছাই, বেগুনি ইত্যাদি রং আছে। প্রতিটি রঙের উপকরণই প্রাকৃতিক। যেমন ডালিমের খোসা আর হরীতকী থেকে পাওয়া যায় সোনালি রং।
নীলের হরীতকী ও ডালিমের খোসার মিশ্রণে পাওয়া যায় সবুজ রং। সবুজ রঙের যেকোনো পণ্য বানাতে এ কারণে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়, জানালেন রাব্বনী। কারণ, এখানে তিনবার ডাই করতে হয়। মঞ্জিষ্ঠার ডাল থেকে পাওয়া যায় মেরুন রং।
পেঁয়াজের খোসা থেকে আসে বাদামি রং। মঞ্জিষ্ঠার ডাল আর নীল রং থেকে আসে কালো রং। কলার মোচা থেকে পাওয়া যায় ছাই রং।
কাজের জন্য সাধারণত নানা কাউন্টের সুতায় বানানো রাজশাহী সিল্ক আর কুমিল্লার খাদি বেছে নেওয়া হয়। নতুন যোগ হয়েছে টাঙ্গাইলের নরম সুতির শাড়ি। প্রচ্ছদের ছবির জন্য সায়রা আক্তার জাহানকে সেটাই পরানো হলো।
সুতির শাড়িটি এতই হালকা যে দুপুরের কড়া রোদেও পরে আরাম পেলেন। বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছবি তুললেন নীলের গাদ বিছানো ট্রের সামনে দাঁড়িয়ে।
কারখানার পাশেই ধানখেত। নীলের গাদ ছাঁকার পর যে পানি বের হয়, সেটা নাকি এখানে দিয়ে দেওয়া হয়। ভালো সার হিসেবে কাজ করে। কোনো রকম কেমিক্যাল ডাই ব্যবহার করা হয় না বলেই জানা গেল। প্রতিষ্ঠানটিতে স্থায়ী কর্মী আছেন ৩০ জন। কাজের ওপর ভিত্তি করে এ সংখ্যা ২০০-ও ছাড়িয়ে যায়।
শিল্পীরা ছাড়াও ২০০ কৃষক পরিবার পাতা সংগ্রহের কাজ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ, বিশেষ করে নারীদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি, স্থানীয় ঐতিহ্য ও নকশাকে পুনর্জাগরিত করা, প্রাকৃতিক উপায়ে কাজ করা এবং কারিগর-কৃষক—সবার ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয় লিভিং ব্লু।