
টনি স্টার্কের চশমার কথা মনে আছে? ‘আয়রন ম্যান’ সিনেমার দৃশ্যে টনি স্টার্ক চশমার দিকে তাকালেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সব তথ্য। ওসব এখন আর সিনেমার গল্প নয়। মার্ক জাকারবার্গের মেটা আর বিখ্যাত চশমা কোম্পানি রে-ব্যান যৌথভাবে সেই ভবিষ্যৎ আমাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। না, হাতের মুঠোয় বলার চেয়ে চোখের সামনে এনে দিয়েছে বললে বোধ হয় জুতসই! ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে মেটা তাদের নতুন রে-ব্যান ডিসপ্লে গ্লাস নিয়ে হাজির হয়েছে। এই চশমার দাম ৭৯৯ ডলার, মানে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯৫ হাজার টাকা। দাম শুনেই চমকে গেলে চলবে না। কারণ, এই দামের পেছনে যে প্রযুক্তি লুকিয়ে আছে, সেটা জানলে আরও বেশি অবাক হবেন।
তবে আসল মজা কিন্তু চশমায় নয়; বরং ধূসর রঙের রিস্টব্যান্ডে। মেটার এই চশমার সঙ্গে আছে একটা বিশেষ ব্যান্ড। ঘড়ি পরার মতোই এই ব্যান্ড পরাও সহজ। তবে এই ব্যান্ড পরলে একটু হালকা বিদ্যুৎ স্পর্শের অনুভূতি পাবেন। ভয়ের কিছু নেই, এই ঝাঁকুনির সাহায্যে ব্যান্ডটি জানান দেয়, ব্যান্ড চালু হয়ে গেছে।
এই ব্যান্ডের নাম নিউরাল ব্যান্ড। এটা আপনার হাতের মাংসপেশি থেকে বের হওয়া বৈদ্যুতিক সংকেত ধরতে পারে। মানে আপনি আঙুল নাড়ালে বা হাতের নির্দিষ্ট অংশ নড়াচড়া করলে, ব্যান্ড সেটা বুঝে ফেলে এবং চশমাকে নির্দেশ দেয়। এই পুরো প্রযুক্তির নাম ইএমজি টেকনোলজি। বিজ্ঞানীরা প্রায় দুই লাখ মানুষের ওপর গবেষণা করে এই প্রযুক্তি তৈরি করেছেন। ফলে প্রায় সবার হাতেই এটা ঠিকমতো কাজ করে।
খুব সহজ। আপনি হাত মুঠো পাকিয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে তর্জনীর ওপর ঘষলে চশমার স্ক্রিনে মেনু স্ক্রল হবে। মুঠোফোনের টাচপ্যাডে আমরা যেভাবে আঙুল ঘুরাই, অনেকটা সে রকম। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী একসঙ্গে চেপে ধরলে নির্দিষ্ট অ্যাপ খুলে যাবে। অনেকটা কম্পিউটারে মাউস ক্লিক করার মতোই।
আবার দুই আঙুল ঘুরিয়ে আলতো করে নাড়ালে গানের ভলিউম বাড়ানো-কমানো যায়। পাশ থেকে আপনাকে কেউ দেখলে মনে হবে, অদৃশ্য কোনো স্টেরিও নব ঘোরাচ্ছেন।
নিউরাল ব্যান্ডের ব্যাটারি এক চার্জে ১৮ ঘণ্টা চলে। সারা দিন ব্যবহার করার জন্য যথেষ্ট। আর এটা পানিরোধী, তাই বৃষ্টিতে ভিজলে বা ওয়ার্কআউট করার সময় ঘাম হলেও কোনো সমস্যা নেই। এর চার্জিং কেসে প্রায় ২৪ ঘণ্টার চার্জ মজুত থাকে।
এবার আসি চশমার কথায়। দেখতে একদম সাধারণ চশমার মতো। কিন্তু ডান চোখের কাছে একটা ছোট্ট ডিসপ্লে লাগানো। চশমা পরলেই ডান গালের ঠিক নিচে একটা পর্দা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। এটা অনেকটা মুঠোফোনের পর্দার মতো, তবে স্বচ্ছ। মানে আপনি চারপাশ দেখতে পাবেন, আবার একই সঙ্গে সেই পর্দাও দেখতে পাবেন।
যাঁরা এই চশমা পরীক্ষা করে দেখেছেন, তাঁরা বলছেন, প্রথম প্রথম একটু অদ্ভুত লাগে। কোথায় ফোকাস করতে হবে, তা চোখ বুঝতে পারে না। বাইরের রাস্তাঘাটও ভেসে থাকে পর্দায়। পর্দাটা খুব পরিষ্কার হলেও আশপাশের উজ্জ্বল আলোর সঙ্গে মিশে গেলে লেখা পড়তে একটু সমস্যা হয়।
তবে এটা মনোরঞ্জনের জন্য নয়, দৈনন্দিন কাজের জন্য। যেমন মেসেজ পড়া, ছবি তোলার আগে প্রিভিউ দেখা, স্পটিফাইয়ে গানের তালিকা দেখাসহ এ রকম কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে।
এই চশমার সবচেয়ে মজার বৈশিষ্ট্য এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। মেটা এআই নামের এই সহকারী আপনার চারপাশ বুঝতে পারে এবং সাহায্য করতে পারে নানাভাবে। সেসবের কয়েকটা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
লাইভ ক্যাপশন ও অনুবাদ
ফিচারটা সত্যিই কাজের। সামনের কেউ কথা বললে চশমার পর্দায় লেখা হয়ে ভেসে ওঠে। ঠিক যেমন সাবটাইটেল দেখা যায়। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার, অন্য ভাষায় কথা বললে সেটা অনুবাদ করে দেখাতে পারে এই চশমা। ধরুন, আপনি জাপানি কারও সঙ্গে কথা বলছেন, কিন্তু কিছু তো বুঝবেন না। তখন আপনার চোখের সামনে তার কথাগুলো বাংলায় ভেসে উঠবে।
ক্যামেরা ভিউফাইন্ডার
এই প্রযুক্তির সাহায্যে আপনি ছবি তোলার আগেই দেখতে পারবেন, ছবিটা কেমন আসবে। চশমা পরে সামনে তাকালেই পর্দায় দেখা যাবে ক্যামেরা কী দেখছে। অনেকটা টিভিতে পিকচার-ইন-পিকচার যেমন হয়, সে রকম। জুমও করা যায় সরাসরি।
মেসেজ চালাচালি
এই সুবিধা বেশ গোপনীয়। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার বা ইনস্টাগ্রামের মেসেজ সরাসরি চশমার পর্দায় দেখা যায়। বারবার মুঠোফোন বের করার দরকার হবে না।
নেভিগেশন
এই ফিচারের সাহায্যে রাস্তা চেনা যাবে। হয়তো নতুন কোথাও যাচ্ছেন, কিন্তু পথ ঠিকভাবে জানা নেই। চশমা আপনাকে মানচিত্র দেখিয়ে পথ বলে দেবে।
ভিডিও কল
চশমা থেকেই এখন ভিডিও কল করা যাবে। মিটিংয়ে বসে স্ক্রিন শেয়ার করাও সম্ভব এই চশমার সাহায্যে।
আরও মজার ব্যাপার হলো, এআই আপনার অভ্যাস শিখে ফেলবে। আপনি সাধারণত কোন সময় কী করেন, তা বুঝে আগেভাগেই এআই সাজেশন দেবে। যেমন কোনো মিটিংয়ে গেলে সেখানে উপস্থিত লোকজনের নাম বলে দেওয়া, রাস্তায় হাঁটলে কাছের রেস্তোরাঁ বা বাসস্ট্যান্ডের খবর জানানো ইত্যাদি। কোন বিল্ডিংয়ের নাম কী, সেখানে কী কাজ হয়, তা–ও চশমায় দেখা যাবে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যদি একটা ভাস্কর্য চোখে পড়ে, তাহলে সেই ভাস্কর্যের ব্যাপারেও তথ্য জানা যাবে এই চশমার সাহায্যে।
পাশাপাশি কোনো কিছুর ছবি তুলে জিজ্ঞেস করতে পারেন, এটা কী? এআই চিনতে পারবে এবং আপনাকে সে সম্পর্কে তথ্য দেবে ও বিষয়টা কী, তা বুঝিয়ে দেবে। যদিও এই ফিচার পরীক্ষার সময় ঠিকমতো কাজ করেনি বলে এক প্রতিবেদক জানিয়েছেন।
গোপনীয়তা নিয়ে চিন্তা
চশমায় ক্যামেরা থাকলে তো গোপনীয়তার প্রশ্ন আসবেই। মেটা এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছে। ক্যামেরা চালু হলে একটা এলইডি বাতি জ্বলে ওঠে। মানে কেউ যদি আপনাকে দেখে, সে বুঝতে পারবে আপনি ছবি বা ভিডিও করছেন।
ভিডিও আর তথ্যগুলো যতটা সম্ভব চশমার ভেতরেই প্রসেস হয়। মেটার সার্ভারে পাঠানোর আগে সেসব এনক্রিপ্ট বা সাংকেতিক করা হয়। এআই ফিচার চালু করার আগে আপনার অনুমতি চাওয়া হবে। তবু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিসরে বা অফিসে এই চশমা পরলে মানুষ অস্বস্তি বোধ করতে পারে। তাই ব্যবহারকারীদের সামাজিক নিয়ম মেনে চলতে হবে।
যাঁরা এই চশমা পরে দেখেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা মিশ্র। কেউ কেউ একে সেরা স্মার্ট চশমার তকমা দিয়েছেন। কারণ, এর পর্দা পরিষ্কার, হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ করা সহজ এবং এআই ফিচার আছে। তবে সবাই এর সঙ্গে একমত হতে পারেননি। সেটাই স্বাভাবিক।
এই চশমার কিছু সমস্যাও আছে। চশমাটা আগের মডেলের চেয়ে একটু ভারী। প্রথমবার হাতের ইশারায় কাজ করাতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করতে হয়। যেমন ক্যামেরা অ্যাপ খুলতে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী একসঙ্গে চেপে ধরতে হয়। কিন্তু সঠিক তাল আর সময় না মিললে কাজ হয় না। মাউস ক্লিক করা যত সহজ, আঙুল চেপে ধরা তত সহজ নয়।
আর সবচেয়ে বড় সমস্যা এর দাম। ৭৯৯ ডলার মানে প্রায় ৯৫ হাজার টাকা। একটা চশমা কেনার জন্য টাকা হয়তো সবার পকেটে নেই। তবে যাঁরা নতুন প্রযুক্তি পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য এটা আকর্ষণীয় হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ সেপ্টেম্বর এই চশমা বিক্রি শুরু হয়েছে। বেস্ট বাই, লেন্সক্র্যাফটার্স, সানগ্লাস হাট ও রে-ব্যান স্টোরে এই চশমা পাওয়া যাচ্ছে। চশমাটির দুই ধরনের আকার—স্ট্যান্ডার্ড ও লার্জ। যাঁরা চশমা পরেন, তাঁরা চাইলে পাওয়ার লেন্সও লাগিয়ে নিতে পারবেন। চশমার ওজন ৬৯-৭০ গ্রাম। একে হালকাই বলা যায়। ট্রানজিশন লেন্স দেওয়া আছে, যেটা ঘরে ও বাইরে আলোর সঙ্গে মানিয়ে নেয়।
২০২৬ সালের শুরুতে কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি আর যুক্তরাজ্যেও এই চশমা বিক্রি শুরু হবে। তবে বাংলাদেশে কবে আসবে, সেটা এখনো জানা যায়নি। প্রযুক্তি যে কত দ্রুত এগিয়ে চলেছে, এই চশমা তার প্রমাণ। হাতের সামান্য নড়াচড়ায় কম্পিউটার চালানো, চোখের সামনে ভেসে ওঠা পর্দা, কথা বললে সেটা লেখা হয়ে যাওয়া—এসব কিছুদিন আগেও সিনেমার দৃশ্য ছিল, এখন বাস্তব।
সূত্র: সিএনবিসি, টেকপয়েন্ট ও মেটা