মাইক শেরিফ যুক্তরাজ্যের মানুষ হলে কী হবে, বলতে পারেন বিশুদ্ধ বাংলা। দরদি গলায় গাইতে পারেন লালন–রবীন্দ্র। বাংলায় তিনটি বইও লিখেছেন। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারি দিয়ে তিন যুগ আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। তার পর থেকে এ দেশ আর মানুষের প্রতি মায়াটা তাঁর বাড়তেই থাকে। মাইকের কাছে বাংলাদেশপ্রেমের গল্প শুনলেন সজীব মিয়া

মাইক শেরিফের ভিজিটিং কার্ডে যোগাযোগের দুটি নম্বর আছে। প্রথম নম্বরের পাশে বন্ধনীর মধ্যে লেখা ‘ইউকে’ মানে যুক্তরাজ্য। দ্বিতীয় মুঠোফোন নম্বরটির পর বন্ধনীতে লেখা ‘বাংলাদেশ’। ভিজিটিং কার্ডে আমার বাড়তি নজর দেখেই হয়তো বললেন, ‘বাংলাদেশেও বছরের অনেকটা সময় থাকা হয়।’ কথাটুকু বললেন কিছুটা সময় নিয়ে, তবে বিশুদ্ধ বাংলায়। ছোট্ট একটা কথা। তবু কেন যেন তাতেও ফুটে উঠল বাংলাদেশের প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ, যেন মাতৃভূমির মতোই বাংলাদেশ তাঁর আরেকটি ঠিকানা।
মাইক এবার তাঁর এই দ্বিতীয় ঠিকানায় এসেছেন গত ২৯ ডিসেম্বর। ঢাকায় লিট ফেস্ট চলছিল তখন। আলোচক হিসেবে ৮ জানুয়ারি লিট ফেস্টে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানকার আনুষ্ঠানিকতা সেরে আসেন কারওয়ান বাজারে, প্রথম আলো কার্যালয়ে। তাঁর কাঁধে ঝুলছিল কাপড়ের ব্যাগ। সভাকক্ষে বসে সেই ব্যাগ থেকে বের করলেন বাংলায় লেখা তাঁর তিনটি বই।
মলাট উল্টে বোঝা গেল, এর মধ্যে প্রথম প্রকাশিত বইটি তাঁর জীবনের খণ্ড খণ্ড গল্প—ভিন্ন অভিজ্ঞতায় ভিন্ন দৃশ্য: আমার জীবন এবং বাংলাদেশ। দ্বিতীয় বইটি তাঁর এক চাচাতো দাদাকে নিয়ে লেখা, নাম এইমস শেরিফের জীবন। ব্রিটিশ আমলে সে দেশের সাধারণ নাগরিকও যে বৈষম্যের শিকার হতো, বইটিতে আছে তারই বয়ান। আর তৃতীয় বইটি ঢাকার পথশিশুদের গল্প নিয়ে—পথের নাম বাড়ি নয়। এটা নতুন বই। মাইক শেরিফ তাঁর তৃতীয় বইটি নিয়ে বলেন, ‘অনেকেই হয়তো পথশিশুদের উপজীব্য করে বই লিখেছেন, আমি এখানে পথশিশুদের গল্পই তুলে ধরেছি।’
বইয়ের আলাপটা খুব দ্রুতই মোড় নিয়ে মাইক শেরিফের জীবনগল্পে ঢুকে পড়ল। যে গল্পের মানুষটা আপাদমস্তক একজন স্বেচ্ছাসেবক। জীবনজুড়ে কাজ করেছেন মানুষের উন্নয়নে, দাতব্য সংস্থার তহবিল সংগ্রহে, শিশুদের নিয়ে। মাইকের কাছে সেই গল্পই শুনতে চাই।
একদিন খবরের কাগজে চাকরির একটি বিজ্ঞাপন দেখে খুব আগ্রহী হয়ে ওঠেন মাইক শেরিফ। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈশ্বিক সংস্থা ‘টেরে দেস হোমস’–এর চাকরির বিজ্ঞাপন। কর্মস্থল বাংলাদেশ। আবেদন করলেন। লন্ডনেই ইন্টারভিউ হলো। কিছুদিন পর জানলেন চাকরিটা পেয়েও গেছেন। ওয়াইএমসিএ ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন নতুন চাকরিতে।
১৯৮৭ সাল। নতুন বছরের শুরুতে উত্তর আমেরিকান এক সহকর্মীর সঙ্গে বাংলাদেশে পা রাখলেন মাইক। ঢাকায় টেরে দেস হোমসের কার্যালয়ে থাকার ব্যবস্থা হলো। কাজের ফাঁকে রিকশায় ঢাকার রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। প্রায়দিনই তাঁর গন্তব্য হতো পুরান ঢাকা। ঢাকায় কিছুদিন থাকার পর একদিন কুড়িগ্রামের পথ ধরলেন। বইতে সে যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাইক লিখেছেন, ‘আমি রাস্তার পাশের ধানখেত দেখে মুগ্ধ হই। ব্রিটেনে খেতগুলো ফাঁকা থাকে, কারণ যন্ত্রের মাধ্যমে কাজ হয়। এখানে খেতে অনেক লোকজনকে কাজ করতে দেখি। খেতগুলো সবুজে সবুজে ভরা। রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের গাড়ির মধ্যে গরুর গাড়িও ছিল। আগে আমি এ রকম গাড়ি দেখিনি।’
নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রামের দিনগুলো কাটতে থাকল। স্থানীয় মানুষ, বাঙালি খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন। মাছ খেতে গিয়ে খালি বিপত্তি বাঁধত। মাছের কাঁটা ছিল তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তত দিনে কুড়িগ্রামে প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে। মোটরসাইকেল চালানোতেও হাত পাকিয়েছেন। এমনই একদিন চিলমারী থেকে কুড়িগ্রামে যাচ্ছিলেন। আচমকা একটা ছাগল এসে বাইকের সামনে পড়ে। পড়ে যান মাইক। প্রথমে ভেবেছিলেন, তেমন ব্যথা পাননি। পরে দেখা গেল, কাঁধের হাড় ভেঙে গেছে। আশানুরূপ চিকিৎসা না পেয়ে ফিরে যান ইংল্যান্ডে। পরে সুস্থ হয়ে উঠলেও চাকরিটা আর ফিরে পাননি।
চাকরি না ফিরে পেলেও বাংলাদেশের সঙ্গে যোগসূত্রটা রয়ে যায়। কারণ, তিনি থাকতেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের অঞ্চল বার্মিংহামে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষে একটি সংস্থার হয়ে এই এলাকাতেই চাকরি করতেন মাইক। তখন থেকে বাংলাদেশি পরিবারের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা শুরু। আর চাকরি নিয়ে বাংলাদেশে আসার আগে এখান থেকেই বাংলা ভাষায় হাতেখড়ি। রেভারেন্ড ক্লিনটন বেনেট নামে এক ধর্মপ্রচারক দীর্ঘদিন বাংলাদেশে ছিলেন। বাংলা ভাষায় তাঁর ভালো দখল ছিল। তাঁর কাছেই বাংলা বর্ণমালা, উচ্চারণ ও খুব সরল শব্দগুলো শিখলেন। দুই মাসের মধ্যে মাইক শেরিফ বাংলা ভাষার সঙ্গে বেশ ভালোই পরিচিত হয়ে গেলেন।
কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে যাওয়ার পর বাংলাদেশি বিভিন্ন সংস্থাকে সাহায্যের কাজ করতেন। সেই সূত্রে প্রায় প্রতিবছরই এ দেশে আসতেন। বিশেষ করে ‘খাসদবির ইয়ুথ অ্যাকশন গ্রুপ’ নামের সিলেটের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পরিচালকদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করেন। ঢাকার একটি পথশিশুদের প্রকল্পেও সাহায্য করতে থাকেন।
এরপর ‘ফ্রেন্ডস অব খাসদবির’ একটি স্বাধীন সংস্থারূপে গড়ে ওঠে। নতুন সংস্থার দাতব্য ট্রাস্টি হন মাইক শেরিফ। তখন তিনি ভাবেন, অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে আসছেন-যাচ্ছেন, তাই সঠিকভাবে বাংলাটাও শেখা চাই। ২০০৬ সাল থেকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বাংলা ভাষার ওপর পড়াশোনা এবং লেখালেখির চেষ্টা করতে থাকলেন। লন্ডনে তাহসিন চৌধুরী নামে এক বাংলার শিক্ষকের কাছে ঋদ্ধ হন। এরই মধ্যে বাংলা ভাষার ওপর জিসিএসই (জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি এডুকেশন) পরীক্ষা দিয়ে পাসও করেন। দিনে দিনে বাংলাদেশেও বাড়তে থাকে যাতায়াত। এখানকার মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশতে থাকেন। গান শোনেন, বই পড়েন। হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই তাঁর পড়া। পড়েছেন বাংলা ভাষার আরও অনেক বই। এভাবেই বাংলা গদ্যচর্চাটাও শুরু।
তবু মাইক শেরিফের কণ্ঠে বিনয় ঝরে পড়ে, ‘বাংলা বাক্য খুবই কঠিন। অনেক সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলতে পারি না। আমি তো ভাবি ইংরেজিতে, তারপর বলি বাংলায়। যদি সরাসরি বাংলায় ভাবতে পারতাম, তাহলে আরও ভালো হতো।’
ইংল্যান্ডের মাঝামাঝি অঞ্চলের শহর লেস্টার। ১৯৫৭ সালে ডিসেম্বরে এই শহরে মাইক শেরিফের জন্ম। তাঁর বাবা আলেক জন শেরিফ ছিলেন ব্যবসায়ী আর মা এলিজাবেথ মেরি শেরিফ শিক্ষক। হম্বাস্টোন নামের স্থানীয় এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাইকের পড়াশোনায় হাতেখড়ি। মাত্র ৯ বছর বয়স থেকে ডায়েরির পাতায় নিজের কথা লিখতে শুরু করেন মাইক। ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মাইক তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, বাংলাদেশকে ব্রিটেনের স্বীকৃতিদানের কথা।
স্কুলজীবনেই স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হন মাইক শেরিফ। তখন তিনি সবে গারট্রি নামের একটি স্কুলে পড়েন। ছোট্ট মাইক তহবিল সংগ্রহের জন্য স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করেন। দলটা টিফিনের সময় ঠান্ডা জুস বিক্রি করত। জুস বিক্রি করে যেটুকু লাভ হতো, সেই টাকা দান করা হতো দাতব্য সংস্থায়। দাতব্য সংস্থার কাজ শেখার প্রতি আগ্রহও তখন থেকে। মাইকের আগ্রহের পালে হাওয়া দেন তাঁরই এক শিক্ষক। এই শিক্ষক নিজেই একটা স্বেচ্ছাসেবক দল পরিচালনা করতেন। অসহায় পরিবার আর নিঃসঙ্গ বৃদ্ধদের সাহায্য করতেন তাঁরা। মাইক বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
পরে আরও বড় পরিসরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ চালিয়ে যান।
মাইক শেরিফ বর্তমানে ফ্রেন্ডস অব খাসদবির এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেন নামে বাংলাদেশি দুটি সংস্থার সভাপতি। সংস্থা দুটির কাজে দেশে এলে তাই বেশির ভাগ সময় ঢাকা ও সিলেটে কাটান। এ দুটি জায়গায় মাইকের বন্ধু আর শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা কম নয়। তাঁদের সঙ্গেই বিভিন্ন জেলায় ভ্রমণে যান মাইক। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবনের মতো অনেক পর্যটনস্থানেই গেছেন। তবে গত সেপ্টেম্বরে ঘুরে আসা হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপকেই পছন্দের জায়গা হিসেবে প্রথমে রাখলেন। এই দ্বীপের পরিবেশ আর মানুষ তাঁর মন জয় করেছে। আর শেষ বেলায় জানালেন, আরেকটি বই লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এখন। সেই বইও মাইক লিখবেন বাংলায়।