জাপানিরা যে কারণে দীর্ঘজীবী হয়

দীর্ঘজীবী হওয়ার কারণে জাপানিদের জীবনযাপনের বিশেষ কিছু পদ্ধতি বিশ্বজুড়ে বেশ জনপ্রিয়। ধীরে খাওয়া, নিয়মিত হাঁটা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার মতো বিষয়গুলোকে জাপানিরা বেশ গুরুত্ব দেয়। এ ছাড়া মিনিমালিজমেও (সরল জীবনযাপন) অভ্যস্ত জাপানিরা।

ইকিগাই

প্রকৃতির মধ্যে মন সব সময় ভালো থাকে
মডেল: প্রিয়ন্তী, পোশাক: ওয়ারাহ, স্থান কৃতজ্ঞতা: সুশি ইয়াকি, সাজ: পারসোনা। ছবি: সুমন ইউসুফ

জাপানিদের জীবনযাপনের জনপ্রিয় এক পদ্ধতি ইকিগাই। ইকি মানে বাঁচা, গাই মানে কারণ। কেন বেঁচে আছেন, তার কারণটা জানা জরুরি।

ইকিগাই: দ্য জাপানিজ সিক্রেট টু আ লং অ্যান্ড হ্যাপি লাইফ বইয়ে জীবনের এ বিষয়ই তুলে ধরেছেন হেক্টর গার্সিয়া। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বইটি এখন পর্যন্ত ৩০ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে।

লেখক মনে করেন, শুধু বয়স্ক নয়, তরুণদের জীবনেও প্রয়োজন ইকিগাই। কারণ, ২০২১ সালে ইউনিসেফের একটি জরিপ বলছে, ১৫-২৪ বছর বয়সী জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ প্রায়ই শঙ্কা বোধ করেন আর বিষণ্নতায় ভোগেন ১৯ শতাংশ।

এ কারণে লেখক মনে করেন, খুব ছোটবেলা থেকেই ইকিগাই অনুসরণ করা উচিত। ইকিগাইয়ে চারটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ—আপনি কী ভালোবাসেন, আপনি কোন কাজের পারদর্শী, আপনার আশপাশে বা পৃথিবীতে মানুষের চাহিদা কী এবং আপনার পেশা কী।

এই চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যে কেউ জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে বের করতে পারে।

জাপানিরা মসলাদার ভারী খাবার এড়িয়ে চলে

পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ জীবনযাপনের জন্য জাপানিরা আরও কিছু বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। যেমন ধীরে খাওয়া, নিয়মিত হাঁটা, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মতো ক্ষুদ্র বিষয়গুলোকে বেশ গুরুত্ব দেয় তারা।

এ ছাড়া জীবনযাপনে অল্পে তুষ্ট থাকায় অভ্যস্ত জাপানিরা। জাপানিদের জীবনযাপনে এমন আরও কিছু অভ্যাস আছে, যার চর্চা আপনার জীবনকেও করে তুলতে পারে সহজ সুন্দর।

হারা হাচি বু

জাপানিরা মসলাদার ভারী খাবার একেবারেই খায় না। তার বদলে সেদ্ধ খাবার খেতে ভালোবাসে। তারা পেট ভরে খায় না। পেটের অন্তত ২৫ শতাংশ জায়গা খালি রাখে। এ পদ্ধতিকে বলে হারা হাচি বু।

তারা মনে করে, এতে শারীরিকভাবে কর্মক্ষম থাকা সম্ভব। হজমের জন্য এ পদ্ধতি বেশ কার্যকর। নিয়মিত মেনে চললে এ পদ্ধতি ওজন কমাতেও কাজে দেয় বেশ।

ঘুম থেকে উঠেই জাপানিরা স্ট্রেচিং করতে ভালোবাসে

রাজিও তাইসো

নিয়মিত শরীরচর্চা জাপানিদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। ঘুম থেকে উঠেই জাপানিরা স্ট্রেচিং করতে ভালোবাসে। এটাকে তারা বলে ‘রাজিও তাইসো’।

রাজিও মানে রেডিও আর তাইসো মানে ব্যায়াম। ১৯২৯ সাল থেকে রেডিওর মাধ্যমে সম্প্রচারিত হচ্ছে বলে এই নাম। ৩ মিনিটের এই ওয়ার্ম-আপ রুটিন ১৩টি সহজ নড়াচড়ার মাধ্যমে শরীরকে সচল রাখতে সাহায্য করে।

জাপানিরা খাওয়ার সময় পেটের অন্তত ২৫ শতাংশ জায়গা খালি রাখে

চা পানে গুরুত্ব

খাবারের পাশাপাশি চা পানের প্রতি জাপানিরা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। জাপানিরা নিয়মিত গ্রিন টি পান করে। চায়ের প্রতিটি চুমুক তারা উপভোগ করে।

চা পানের এই রীতি ‘চানোয়ু’ ধৈর্য ও মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে। এ পদ্ধতি মেনে চললে মানসিক প্রশান্তি আসে এবং বর্তমান মুহূর্তের সঙ্গে তৈরি হয় গভীর সংযোগ। আর গ্রিন টির স্বাস্থ্যগুণ তো বাড়তি পাওনা।

ত্বকের যত্ন

ত্বকের যত্নে জাপানিরা গোসলকে বেশ প্রাধান্য দিয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ ধরে তারা শাওয়ারের পানির ধারায় থাকে। ত্বকের যত্নে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিজ্জ সুবাস।

পোশাকে প্রাকৃতিক উপকরণ

শুধু ত্বকচর্চাতেই নয়, পোশাকেও প্রাকৃতিক উপকরণের ব্যবহার ভালোবাসে জাপানিরা। পোশাকে হালকা রং ব্যবহারের পাশাপাশি আরামের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয় তারা।

জাপানিরা নিয়মিত গ্রিন টি পান করে

হাঁটাকে প্রাধান্য

জাপানিরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে হাঁটাকে বেশ প্রাধান্য দিয়ে থাকে। নিয়মিত হাঁটা একধরনের প্রাকৃতিক শরীরচর্চা, যাতে আলাদা কোনো খরচ বা যন্ত্রপাতির প্রয়োজন নেই।

আলোর সংস্পর্শ

জাপানিরা দিনের আলোর সংস্পর্শে থাকতে খুব ভালোবাসে। মন ও শরীরকে সুস্থ রাখতে দিনের আলো ও বাইরের সতেজ বাতাসকে কাজে লাগায়।

ঘুমকে গুরুত্ব দেওয়া

জাপানিরা মনে করে, ভালো ঘুম শরীর ও মনকে পুনর্জীবিত করতে সহায়তা করে। এতে পরের দিন পূর্ণ শক্তিতে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়। তাই ঘুমকে অলসতা বা বিশ্রাম হিসেবে নয়, বরং আত্মযত্ন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাপানে দিনের বেলায় একটু ঘুমিয়ে নেওয়া বা ‘ইনেমুরি’ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত।

বাহুল্যবর্জিত জীবন

জাপানিরা অন্দরকে ছিমছাম রাখতে পছন্দ করে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলে দেয়। এ ছাড়া বসবাসের জিনিসপত্র, বিশেষ করে ওয়ার্ডরোব বা আলমারির প্রতিটি জিনিস ‘কনমারি মেথড’ অনুসরণ করে নির্দিষ্ট জায়গায় এমনভাবে সাজিয়ে রাখে, যাতে সহজে খুঁজে পাওয়া যায়, কখনো অগোছালো না থাকে।

অন্দর থাকুক ছিমছাম

কৃতজ্ঞতার চর্চা

‘আরিগাতো’ বা ‘ধন্যবাদ’ বলা জাপানি সংস্কৃতিতে শুধু সামাজিক ভদ্রতা নয়, বরং এক গভীর জীবনবোধ। এই ‘আরিগাতো’ শব্দ খাবার, মানুষ ও প্রতিটি ছোট ছোট মুহূর্তের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। এ অভ্যাস দিনকে করে তোলে আরও ইতিবাচক ও হৃদয়গ্রাহী।

সম্প্রতি বিবিসি নিউজে প্রকাশিত একটি খবরে উঠে আসে জাপানে ১০০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা এবার প্রায় ১ লাখে পৌঁছেছে। এমনটাই জানিয়েছে দেশটির সরকার।

এ বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৯৯ হাজার ৭৬৩ জন শতবর্ষী ছিলেন, যার মধ্যে ৮৮ শতাংশ নারী। জাপানের মানুষ সাধারণত দীর্ঘজীবী হয়। এর অন্যতম কারণ হিসেবে জীবনযাপনের এই রীতিগুলো সহায়তা করে নিশ্চয়ই।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, জাপানহুইজপার ডটকম, সাইকি, মিডিয়াম, টাইমস অব ইন্ডিয়া