
নভেম্বর ডায়াবেটিস সচেতনতা মাস। এ উপলক্ষে ২৪ নভেম্বর কংগ্রেসিয়া ও প্রথম আলোর আয়োজনে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন দেশের কয়েকজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘ডায়াবেটিস আমার, দায়িত্বও আমার’। সহযোগিতায় ছিল হেলদি লিভিং ট্রাস্ট। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেন। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। তাঁর বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো।
ডায়াবেটিস পৃথিবীতে এক মহামারি। একে মহামারি হিসেবে প্রথম চিহ্নিত করেছিল ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন। পরে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন এবং ২০০৬ সালে ইউনাইটেড নেশনস ডায়াবেটিসকে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করে। ইউনাইটেড নেশনসের ডায়াবেটিসকে মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা রয়েছে। কারণ, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অনুরোধেই বাংলাদেশ সরকার এ কথা ইউনাইটেড নেশনসের কাছে তুলেছিল। পরে তা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। ২০০৭ সাল থেকে ১৪ নভেম্বর ‘ইউএন ডে ফর ডায়াবেটিস’ হিসেবে দিনটি পালিত হচ্ছে।
ডায়াবেটিসের মহামারিটা হচ্ছে মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিসের জন্য, যেটা শুরুতে ইনসুলিননির্ভর নয়। এটি বহুলাংশেই প্রতিরোধ করা যায়। প্রশ্ন হলো, এটা রোগপ্রতিরোধযোগ্য হলেও বাড়ছে কেন। ডায়াবেটিস বর্তমানে উন্নত বিশ্বের চেয়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেই বেশি বাড়ছে। ডায়াবেটিস হওয়ার মূল কারণ জিনগত ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব। জিনগত প্রভাব পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে জীবনধারা পরিবর্তন করলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু অসুবিধা হলো জীবনধারা পরিবর্তন করার সুবিধাগুলো আমাদের কাছে খুব কম। যেমন মানুষকে আমরা বলছি হাঁটাচলা করতে, ফাস্ট ফুড পরিহার করতে। কিন্তু আমাদের হাঁটাচলার জায়গা নেই আর ফাস্ট ফুডের দোকান তো শিশুদের স্কুলের পাশেই বেশি।
আমরা ডায়াবেটিক সমিতি থেকে একটি গবেষণা করেছি, যেটা ২০ অক্টোবর প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ইমামদের মাধ্যমে খুতবায় কিছু বলালে সেটায় মানুষের ওপর বিশাল প্রভাব পড়ে। আমাদের গবেষণা করতে হবে আরও কীভাবে বললে মানুষ জীবনধারার পরিবর্তন আনবে।
ডায়াবেটিস হলেই আমরা বলে থাকি এই রোগ আজীবনের জন্য। কিন্তু দেখা যায়, ডায়াবেটিস ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করলে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে কমপ্লিট রেমিশন (উপসর্গ পুরোপুরি অদৃশ্য) হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া মহামারি না হলেও টাইপ-১ ডায়াবেটিস বাড়ছে। আমাদের চেয়ে সেটা উন্নত বিশ্বে বেশি। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৫ শতাংশের কম। এই রোগীরা সম্পূর্ণভাবে ইনসুলিনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের সবার যেমন অক্সিজেন, পানি ও খাবার প্রয়োজন। এসব ছাড়াও তাঁদের তেমন ইনসুলিন প্রয়োজন। এটি তাঁদের মানবাধিকার। তাঁদের জন্য ইনসুলিন সহজলভ্য করতে হবে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মতো গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের সন্তানেরও ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটি নিয়েও আমরা একটি গবেষণা করছি। এবং আমরা দেখেছি গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসও প্রতিরোধ করা যায়।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এ বছর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘কর্মস্থলে ডায়াবেটিস সচেতনতা গড়ে তুলুন’। এটি খুবই যুগোপযোগী, কারণ এখন মানুষকে জীবনের অনেকটা অংশ তাঁর কর্মস্থলে ব্যয় করতে হয়। আবার যারা স্কুলে পড়ে, তাদের জন্য স্কুলটাই কর্মস্থল। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অফিসের নীতিনির্ধারকেরা যদি সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেন, তাহলে তাঁদের কর্মচারীদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।