আপনি কি খাবার সংরক্ষণের জন্য নিয়মিত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ব্যবহার করেন? তাহলে চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এই ফয়েল খাদ্যে বিষক্রিয়াসহ নানা সমস্যা ডেকে আনতে পারে। মনে রাখবেন, চকচকে মানেই স্বাস্থ্যকর নয়।

দোকানপাট থেকে শুরু করে ফুডকোর্ট—বিভিন্ন জায়গায় অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দেখা যায়। কিন্তু এটি আদতে কী? নাম দেখেই যেমনটা বোঝা যায়, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের মূল উপাদান হলো অ্যালুমিনিয়াম (৯৮.৫%)। সঙ্গে মেশানো থাকে লোহা ও সিলিকন।
অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল নিজে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে না। তবে ফয়েলগুলো দিয়ে যেভাবে থালাবাসন ঢেকে রাখা হয়, তাতে ব্যাকটেরিয়া বাড়তে পারে।
প্লেটের ওপর সাবধানে ফয়েল জড়িয়ে রাখলেও পুরোপুরি বায়ুরোধী হয় না। অর্থাৎ বাতাস ভেতরে ঠিকই প্রবেশ করে। আর খাবারের পাত্র বায়ুরোধী করে না মোড়ালে কিছু ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি আরও সহজ এবং দ্রুততর হয়।
স্টাফ (লাল মাংস ও হাঁস-মুরগিতেও পাওয়া যায়) এবং ব্যাসিলাস সেরিয়াস (উচ্ছিষ্ট ভাত এবং অন্যান্য স্টার্চযুক্ত খাবারে থাকে) হলো দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়া, যেসবের বৃদ্ধি এবং বংশবিস্তারের জন্য বাতাসের প্রয়োজন হয়। এই দুটি জীবাণুই উচ্চ তাপমাত্রায় খাবার আবার গরম করলেও মরে যায় না, তাই এসব বিশেষভাবে বিপজ্জনক।
আমরা সদ্য রান্না করা খাবার গরম–গরম পরিবেশন করতে ফয়েল ব্যবহার করি। এতে খাবার গরম থাকে ঠিকই। কিন্তু আখেরে স্বাস্থ্যের উপকারের চেয়ে অপকারই হয় বেশি।
অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল সাধারণত প্লাস্টিক র্যাপ ও কোটেড ওয়াক্স পেপারের চেয়ে বেশি তাপ ধারণ করে। এতে খাদ্যদ্রব্য দ্রুত পচে যেতে পারে।
অনেক সময় খাবার পুরোপুরি ঠান্ডা হওয়ার আগেই ফয়েল দিয়ে ঢাকা হয়। এ ক্ষেত্রে খাবারে ১০৪ থেকে ১৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বজায় থাকে। এতে ব্যাকটেরিয়ার দ্রুত বংশবিস্তার ঘটে। ফয়েল যদি ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে শুধু ঠান্ডা খাবার মুড়িয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করাই নিরাপদ।
গবেষকেরা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়ানো বেকড পটেটো থেকে খাবারে ‘বটুলিজম’ নামক বিষক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন। ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনাম নামক জীবাণুর দেহ থেকে যে বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত হয়, তা আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে মৃত্যুও হতে পারে।
খোসাসহ আলু কখনোই ফয়েলে মুড়িয়ে রাখা উচিত নয়। আলু ফয়েলে মোড়ালে অক্সিজেন পায় না। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলো এটিই চায়। আলুর খোসায় ময়লা থাকবেই। রান্না করার আগে ধুয়ে নিলেও থাকবে।
তাই খোসাসহ আলু বেক করা যাবে না। কারণ, খোসায় ময়লা এবং ব্যাকটেরিয়া বাসা বাঁধে। তবে রান্না করার সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে ফেললে খোসাসহ আলু নিরাপদ।
বটুলিজম পুরোনো আলুতে বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফ্রিজে দীর্ঘদিন আলু রেখে দিলে তাতে বটুলিজম হওয়ার ঝুঁকি সদ্য রান্না করা আলুর চেয়ে বেশি। কারণ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়ে। সঠিক তাপমাত্রায় আলু সংরক্ষণ করলে এই প্রক্রিয়া শ্লথ হয়ে আসে। কিন্তু ফয়েলে মুড়িয়ে রাখলে আরও দ্রুততর হয়।
অম্লজাতীয় খাবার, যেমন টমেটো সস অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলকে ক্ষয় করে। ফলে খাবারে অ্যালুমিনিয়াম ঢুকে পড়তে পারে। অ্যালুমিনিয়াম স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্যের মাধ্যমে এই ধাতু মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রে জমে থাকতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, আলঝেইমার্স ডিজিজে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মস্তিষ্কে অ্যালুমিনিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলকে সরাসরি খাদ্যের সংস্পর্শে রাখা যাবে না। খাবার সংরক্ষণের জন্য কনটেইনার ব্যবহার করাই উত্তম।
খাদ্যে বিষক্রিয়া থেকে আপনি অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। বিষয়টি কিছু কিছু ব্যক্তির জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী, দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি ইত্যাদি।
তবে কিছু সময়ের জন্য ফয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন বাসা থেকে কোনো পিকনিক স্পটে কিছু স্যান্ডউইচ মুড়িয়ে নেওয়ার জন্য ফয়েল ব্যবহার করা যায়। ফয়েলে মুড়িয়ে দীর্ঘদিন খাদ্যদ্রব্য রেখে দেওয়া যাবে না—এইটাই হলো আসল কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) মতে, বায়ুরোধী পাত্র কিংবা সিল করা স্টোরেজ ব্যাগে খাবার সংরক্ষণ করা সবচেয়ে নিরাপদ। বেশির ভাগ রান্না করা খাবার সংরক্ষণের ক্ষেত্রেই এসব পদ্ধতি কার্যকর। এতে খাবার দ্রুত পচে না।
অবশ্য এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। কাঁচা সবজি, গোল আলু, মিষ্টি আলু, পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে ঘরে তৈরি সস বা এ–জাতীয় খাবার বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করা যাবে না। অক্সিজেনের অভাবে ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনিয়াম দ্রুত জন্মে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সদ্য রান্না করা খাবার খাওয়ার আগে দুই ঘণ্টার বেশি ফ্রিজে রাখা উচিত নয়। ফ্রিজে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা বেঁচে যাওয়া খাবার তিন-চার দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলতে হবে। ফ্রোজেন খাবার ছয় মাসের বেশি রেখে দেওয়া অনুচিত।
সূত্র: রিডার্স ডাইজেস্ট