কিনোয়া একধরনের শস্য। দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই কিনোয়ার চাষ হয়ে আসছে। পুষ্টিগুণের কারণে বর্তমানে এই শস্যের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অনেকেই একে সুপার গ্রেইন বলে থাকেন। ফাইবার, অ্যান্টি–অক্সিডেন্টসহ অনেক পুষ্টিগুণে ভরপুর কিনোয়া উদ্ভিজ্জ খাবারের মধ্যে একটি সম্পূর্ণ প্রোটিন। এমন ৯টি প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড এতে রয়েছে, যা শরীর নিজে তৈরি করতে পারে না। কিনোয়ায় চাল, গম, ভুট্টা, বার্লি ও ওটসের চেয়ে বেশি প্রোটিন আছে। কিনোয়ায় থাকা প্রোটিন আপনার পেশি, হাড় ও সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রোটিনের পাশাপাশি ফাইবার, আয়রন, থায়ামিন, কপার, ভিটামিন বি৬–এরও ভালো উত্স কিনোয়া; রয়েছে ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম ও ফোলেট, যা শরীরে নানা উপকার করে থাকে। ১ কাপ (১৮৫ গ্রাম) রান্না করা কিনোয়ায় থাকে ২২২ গ্রাম ক্যালরি, ৩৯ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৪ গ্রাম চর্বি, ৮ গ্রাম প্রোটিন, ৫ গ্রাম আঁশ, ১ গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ১৩ মিলিগ্রাম সোডিয়াম।
১. কিনোয়া প্রাকৃতিকভাবেই গ্লুটেনমুক্ত খাবার। ফলে যাঁদের গ্লুটেন সংবেদনশীলতা বা সিলিয়াক ডিজিজ আছে, তাঁদের জন্য আদর্শ খাবার।
২. কিনোয়ায় ভালো পরিমাণে ফাইবার আছে। এই ফাইবার হজমে সাহায্য করে। এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে, যে কারণে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়।
৩. কিনোয়ায় অদ্রবণীয় ফাইবারের পাশাপাশি অল্প পরিমাণে শর্করা ও কিছু প্রতিরোধী স্টার্চ আছে। এটি অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া বাড়ায় ও পরিপাকতন্ত্র ভালো রাখে। দীর্ঘ সময়ের জন্য খিদে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে।
৪. কিনোয়ায় প্রচুর ফ্ল্যাভোনয়েড আছে, যার মধ্যে দুটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—কোয়ারসেটিন ও কেমফেরল। ফ্ল্যাভোনয়েড এমন একটি অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, যা অস্টিওপোরোসিস, কার্ডিওভাস্কুলার ও ক্যানসারের মতো রোগ প্রতিহত করতে সাহায্য করে। এই ফ্ল্যাভোনয়েডগুলো শরীরের ক্ষতিকর কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়।
৫. কিনোয়ায় পটাশিয়াম, জিংক, আয়রন ও ম্যাগনেশিয়ামের মতো চারটি খনিজ উপাদান মেলে। এর মধ্যে ম্যাগনেশিয়াম ও আয়রন বেশি। ম্যাগনেশিয়াম রক্তনালিগুলোকে শিথিল করতে ও মাইগ্রেন উপশম করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া এটি টাইপ–টু ডায়াবেটিস, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, হাড় ও দাঁতের গঠন ভালো করে। ভালো ঘুমেও সাহায্য করে। আয়রন আমাদের দেহের রক্ত তৈরি করতে ও রক্তপ্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে।
৬. কিনোয়া ডায়াবেটিক রোগীদের জন্যও নিরাপদ। রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৭. কিনোয়ায় লাইসিন আছে, যা ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক ভালো করতে সাহায্য করে। ত্বকের সার্বিক স্বাস্থ্য উন্নত করে।
৮. কিনোয়ায় পলিফেনল আছে, যা শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
৯. নিউট্রিয়েন্টস জার্নালের এক সমীক্ষায় কিনোয়ায় বিদ্যমান ওমেগা–থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যামিনো অ্যাসিড ও প্রোটিনের কথা তুলে ধরে বিশেজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অপুষ্টির সংকটের সমাধান দিতে পারে এই খাবার।
অনেক জাত ও রঙের হয় কিনোয়ার বীজ। তার মধ্যে সাদা, লাল ও কালো রঙের চল বেশি। সাদা কিনোয়া রান্না করতে সাধারণত সবচেয়ে কম সময় লাগে এবং এটি সবচেয়ে নরম ও হালকা হয়। আর লাল কিনোয়া রান্না করতে বেশি সময় লাগে, খেতেও সুস্বাদু। এটি সালাদ ও বেকিংয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। হালকা মিষ্টি স্বাদের কালো কিনোয়া চিবিয়েও খাওয়া যায়।
কিনোয়ায় স্যাপোনিন নামক একটি তিক্ত আবরণ রয়েছে। প্রবহমান পানিতে ধুয়ে এটি দূর করতে হয়। তারপর দ্বিগুণ পরিমাণে পানি দিয়ে রান্না করা হয় কিনোয়া। প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট খোলা রেখে তারপর ঢেকে আঁচ কমিয়ে ১০ মিনিট রাখুন। সেদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে নিন। এভাবে রান্না করে সরাসরি খাওয়া যায়, আবার অন্য খাবারের সঙ্গে মিশিয়েও খেতে পারেন। সালাদ, স্মুদি ও স্যুপের সঙ্গে মিশিয়ে কিনোয়া খাওয়া হয় বেশি। ভাত ও রুটির পরিবর্তেও খেতে পারেন কিনোয়া। রান্না করা কিনোয়া দই বা দুধের সঙ্গে মিশিয়েও খেতে পারেন।
রান্না করার পর কিনোয়া তুলতুলে নরম হয়ে যায়। সামান্য বাদামের স্বাদ মেলে। কিনোয়ার গুঁড়া দিয়ে রুটি ও পাস্তার মতো খাবারও তৈরি করা যেতে পারে।
স্যাপোনিন থাকার কারণে কিনোয়া হজমে কিছু মানুষের সমস্যা হতে পারে। যেকোনো খাবারের মতো কিনোয়াও পরিমিত খেতে হবে। কারণ, এতে ফাইবার ও প্রোটিনের পরিমাণ বেশি, যা অতিরিক্ত গ্রহণে পেট খারাপ, গ্যাস, পেট ফাঁপা ও ডায়রিয়া হতে পারে। অতিরিক্ত কিনোয়া খেলে কিডনির সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে শরীরে যদি অক্সালেট সংবেদনশীলতা থাকে। প্রতিদিন আধা কাপ থেকে এক কাপ রান্না করা কিনোয়া খাওয়া ভালো। যাঁরা প্রথমবার খাবেন, তাঁরা আরও কম পরিমাণে শুরু করতে পারেন।
লিনা আকতার: পুষ্টিবিদ, রাইয়ান হেলথ কেয়ার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, দিনাজপুর