২০২১ সাল থেকে অসুস্থ ডা. আরজুমান আরা বেগম। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ২০২২ সালে ধরা পড়ে, ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছেন তিনি। চতুর্থ স্টেজ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তখন আরজুমানের সন্তানকে আলাদা করে ডেকে বলেছিলেন, তাঁর হাতে বড়জোর আর মাস ছয়েক সময় আছে। আজও লড়ে চলেছেন ডা. আরজুমান। ফুসফুস ক্যানসার সচেতনতার মাসে তাঁর জীবনের গল্প শোনাচ্ছেন রাফিয়া আলম

২০১৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন ডা. আরজুমান আরা বেগম। ২০২১ সালের মাঝামাঝি তাঁর করোনা ধরা পড়ে। চিকিৎসায় করোনামুক্ত হলেও কাশি থেকে যায়। আরজুমান ও তাঁর স্বামী দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক। তাঁদের কনিষ্ঠ পুত্রও তখন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক। বাড়িতেই অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া হলো। তারপরও কাশি সারছিল না। শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল।
২০২১ সালের শেষ নাগাদ আরজুমানের ফুসফুসে একটা গোটা ধরা পড়ে। তিনি ঠিক করলেন, চিকিৎসার জন্য বাইরে যাবেন। সব ঠিকঠাক করে পরের বছর মার্চে ভারত গেলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ল চতুর্থ স্টেজের ক্যানসার। তখনই তাঁর সন্তানকে নিরাশার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসক।
আরও কিছু জিনোমিক পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে নমুনা পাঠানো হলো। একটি কেমোও দেওয়া হলো। প্রতি মাসে একটি করে আরও তিনটি কেমোর নির্দেশনা দেওয়া হলো। দেশে ফিরে এলেন আরজুমান।
নমুনা পাঠানোর ছাব্বিশ দিন পর পাওয়া গেল সেই পরীক্ষার রিপোর্ট। দেশে বসেই বিদেশি চিকিৎসককে রিপোর্টের তথ্য জানানো হলো। চিকিৎসক জানালেন, কেমোথেরাপি নয়, রোগীর প্রয়োজন টার্গেটেড থেরাপি।
কিন্তু দেশের বাজারে সেই ওষুধ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সময়টা যে করোনা অতিমারির। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে পাওয়া গেল ওষুধ। একটু একটু করে সেরে উঠতে থাকলেন আরজুমান। রোজ দুই বেলা চারটি করে মোট আটটি ওষুধ খেতে হচ্ছিল।
নিয়মমাফিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকেছেন আরজুমান। পরামর্শ অনুযায়ী পেট সিটি স্ক্যান করিয়েছেন। সেসব পরীক্ষার রিপোর্টে দেখা গেল, ধীরে ধীরে কমে আসছে টিউমারের আকার। তবে ২০২৪ সালের জুলাই মাসের পর ভিসা জটিলতায় আর ভারতে যেতে পারেননি। আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে আবারও কাশি আর শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে।
পরিস্থিতি শুরুর দিকের চেয়েও খারাপ হতে থাকে। এ বছর এপ্রিল মাসে আবার ভারত যান আরজুমান। তত দিনে চিকিৎসাবিজ্ঞানও আরেকটু উন্নত হয়েছে। এখন আরও বেশি কার্যকর টার্গেটেড থেরাপি নেওয়া সম্ভব। নতুন ওষুধের ডোজ নির্ধারণ করে দিলেন চিকিৎসকেরা।
দেশে ফিরে ওষুধ শুরু করার দ্বিতীয় দিনেই কাশি কমে গেল। আগস্ট মাসে পেট সিটি স্ক্যান করে জানা গেল, ক্যানসারের এই দীর্ঘ লড়াইয়ে এবারই সবচেয়ে ছোট হয়ে এসেছে টিউমারের আকার।
আরজুমানকে রোজ এখন একটি করে ওষুধ খেতে হচ্ছে। খরচও অনেক কমেছে। আরজুমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান এ টি এম ফরহাদ বলছিলেন, ‘মায়ের ওষুধের জন্য আগে যেখানে মাসে খরচ হতো এক লাখ কুড়ি হাজার টাকার মতো, এখন তা নেমে হয়েছে পঞ্চাশ হাজার। মায়ের চিকিৎসার জন্য আমরা নিজেদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে এনেছি। কিন্তু কখনোই তাঁর চিকিৎসার ব্যয় সংকোচন করিনি।’
আরজুমান জানালেন, শারীরিকভাবে এখন তিনি সুস্থ। মনেও জোর আছে। আসছে পবিত্র রমজানে রোজা রাখার ইচ্ছা রাখেন। সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন। এখন নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে তিন নাতিকে নিয়ে দিব্যি সময় কাটছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘুরতেও যাচ্ছেন। গত মাসেই ঘুরে এলেন সিলেট।
জীবন অনিশ্চিত। সে তো সবার জন্যই সত্য। তবে জীবন নিঃসন্দেহে সুন্দর। সুন্দর এই জীবনে কাছের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে আনন্দে থাকার মাঝেই তো সুখ। সেই সুখের আয়োজনেই এখন দারুণ এক জীবন কাটাচ্ছেন লড়াকু আরজুমান।