লিভার বা যকৃত আমাদের দেহের সবচেয়ে বড় গ্রন্থি। কোনো কারণে এই লিভার বিকল হয়ে পড়লে বা পড়ার উপক্রম হলে তার প্রভাব শরীর তো বটেই, মস্তিষ্কেও পড়ে। এতে ঘুমের সমস্যা থেকে শুরু করে মানসিক বৈকল্য পর্যন্ত তৈরি হতে পারে।
রাতে ঘুমের কিছু লক্ষণ দেখে অনেক সময় লিভারের জটিলতা সম্পর্কে সজাগ হওয়া যায়। আগে থেকে এসব লক্ষণ টের পেলে সময়মতো চিকিৎসাগ্রহণ থেকে শুরু করে জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন আনা সম্ভব। এতে আরও বড় জটিলতা থেকে লিভারকে রক্ষা করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে ‘লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির ঘুমের ব্যাঘাত: প্রাদুর্ভাব, প্রভাব ও ব্যবস্থাগ্রহণে চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণায় এসব বিষয়ে আলোকপাত করা হয়।
ওই গবেষণায় বলা হয়, যাঁরা লিভারের রোগে আক্রান্ত, তাঁরা সাধারণত ঘুমাতে দেরি হওয়া, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়াসহ পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার সমস্যায় ভোগেন। তাঁরা দিনের বেলায়ও প্রচণ্ড ঘুম ঘুম ভাবের সমস্যায় পড়েন।
গবেষণায় বলা হচ্ছে, এসব সমস্যার মূল রোগটি হচ্ছে লিভারজনিত মানসিক অসুস্থতা বা হেপাটিক এনসেফ্যালোপ্যাথি। এটা মস্তিষ্কের এমন একটি অবস্থা, যখন লিভার বিকল হওয়ার কারণে তা আর শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বাইরে বের করে দিতে পারে না। তখন এসব বিষ মস্তিষ্কের কাজে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলে।
যকৃত বিকল হলে তা শরীরের মেলানিন নামের হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই হরমোন আমাদের শরীরের কখন ঘুমাতে হবে, তা ঠিক করে দেয়। মেলানিন বেশি হয়ে গেলে তা দেহঘড়ির ঘুমের চক্রকে ওলটপালট করে দেয়।
লিভারের রোগীরা সাধারণত ইনসমনিয়া বা অনিদ্রায় ভোগেন।
এ কারণে অনেকের ঘুম আসতে দেরি হয়, কেউ মাঝরাতে জেগে ওঠেন, কারও–বা ঘুম পর্যাপ্ত হয় না।
ফলে দিনে ঘুম ঘুম ভাব থেকে যায়।
কারও দিন–রাতের চক্রই ওলটপালট হয়ে যায়।
এ কারণে সারা রাত জেগে থেকে দিনের বেলায় ঘুমাতে শুরু করেন।
দিনের কাজকর্ম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
আমাদের শরীরে ঘুমের অনুভূতি তৈরি করে মেলাটোনিন হরমোন। যকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা এই অতিরিক্ত হরমোন বের করে দিতে পারে না। এই বেশি মেলাটোনিন শরীরকে দিন-রাতের বিষয়ে বিভ্রান্ত করে। ফলে কখন ঘুমাতে হবে, শরীর তা বুঝতে পারে না।
এ ছাড়া রক্তে শর্করার কমবেশি, তাপমাত্রার ওঠানামা—এসবও ঘুম ব্যাহত করার জন্য দায়ী। ফলে তা শরীরকে ক্লান্ত, অবসন্ন, মেজাজকে খিটখিটে ও দেহকে অকর্মণ্য করে তোলে।
ঘুমের সমস্যা কীভাবে হেপাটিক এনসেফ্যালোপ্যাথি (এইচই) তৈরি করে
যখন যকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তা শরীরের ভেতরের বিষাক্ত পদার্থ বের করে দিতে পারে না। ফলে অনেক সময় তা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। তখন ক্ষতিকর হরমোন বা বিষাক্ত পদার্থ শরীরে বেশি হয়ে তা ঘুমকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ঘুমের একটানা সমস্যা একসময় মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। এ কারণে হালকা বিভ্রান্তি থেকে শুরু করে গুরুতর মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। প্রথম দিকে মনোযোগহীনতা থেকে শুরু হয়ে মেজাজে পরিবর্তন আসে। গুরুতর পর্যায়ে তা মস্তিষ্ককে কোমায় নিয়ে যেতে পারে।
রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের জন্য সাধারণ জীবনযাপন রীতি মেনে চলা উচিত। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে। ঘুমের আগে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিথিল হওয়াসহ সহজ কিছু যোগব্যায়াম ও পদ্ধতি অবলম্বনের চেষ্টা করা যেতে পারে। এ ছাড়া—
ঘুমাতে যাওয়ার আগমুহূর্তে ভারী খাবার ও অ্যালকোহল বর্জন করুন।
আপনার শোবার ঘর অন্ধকারাচ্ছন্ন, শান্ত ও নীরব করুন।
শোয়ার কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে মুঠোফোন ঘাঁটা বা টেলিভিশন দেখা বাদ দিন। এসব যন্ত্র থেকে বের হওয়া ব্লু রে বা নীলরশ্মি মেলাটোনিন নিঃসরণে প্রভাব ফেলে, যা ভালো ঘুমের পরিপন্থী।
এসবেও কাজ না হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কে না জানে, ভালো ঘুমে সুস্থবাস, অল্প ঘুমে স্বাস্থ্যনাশ।
সূত্র: ইয়াহু