আমাদের দেশে নারীস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো বরাবরই খুব উপেক্ষিত। এন্ডোমেট্রিওসিস ও অ্যাডিনোমায়োসিসের মতো মারাত্মক রোগের ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করতে এবং দেশে এ রোগে ভুগতে থাকা বিশালসংখ্যক নারীকে চিকিৎসার আওতায় এনে পরবর্তী আরও সব ভয়ংকর জটিলতা থেকে রক্ষা করাই এন্ডোমেট্রিওসিস অ্যান্ড অ্যাডিনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ইএএসবি) সংস্থার উদ্দেশ্য।

এই সংস্থার উদ্যোগে প্রতি শুক্রবার ‘প্রথম আলো’র ফেসবুক পেজে প্রচারিত হচ্ছে নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘ভয়েস অব এন্ডোমেট্রিওসিস’। গত ১২ আগস্ট প্রচারিত হলো অনুষ্ঠানটির ৫০তম পর্ব। সঞ্চালনায় ছিলেন ইএএসবির সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি ডা. শারমিন আব্বাসি। এই আয়োজনের জন্য প্রথম আলো এবং মিডিয়া পার্টনার নুভিসতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু এন্ডোমেট্রিওসিস ও অ্যাডিনোমায়োসিস–বিষয়ক নিয়মিত কোনো আলোচনা অনুষ্ঠান দেশে এটাই প্রথম। ৫০তম পর্বে পা দেওয়া অনুষ্ঠানটি এই দুটি জটিল রোগের সচেতনতা তৈরিতে মাইলফলকের ভূমিকা পালন করছে।’
অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন ইএএসবির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশের অবস্ট্যাট্রিক্যাল ও গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটির সাবেক সভাপতি। আলোচক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ইএএসবির জাতীয় উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. টি এ চৌধুরী, ভারতের কলকাতায় অবস্থিত মুকুন্দপুরের প্রসূতি হাসপাতালের চিকিৎসক সুরঞ্জন চক্রবর্তী, ইএএসবির ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম, ইএএসবির জাতীয় উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. লায়লা আর্জুমান্দ বানু, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী, ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. পারভীন ফাতেমা এবং এডিটর অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই ইএএসবির সভাপতি ডা. সামিনা চৌধুরী রচিত একটি হৃদয়গ্রাহী গানের মধ্য দিয়ে সবার কাছে এন্ডোমেট্রিওসিস ও অ্যাডিনোমায়োসিস–বিষয়ক বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। ৫০তম পর্বে এসে অনুষ্ঠানের সফলতার দিকগুলো তুলে ধরেন ডা. সামিনা চৌধুরী। তিনি জানান, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানটি ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। এখানে মূল্যবান বক্তব্য ও পরামর্শ দিয়েছেন ২২২ জন দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
এরপর আলোচনা করেন কলকাতার মুকুন্দপুরের প্রসূতি হাসপাতালের স্বনামধন্য চিকিৎসক সুরঞ্জন চক্রবর্তী। তাঁর পরামর্শ ও উৎসাহেই আমাদের দেশে এই এন্ডোমেট্রিওসিস ও অ্যাডিনোমায়োসিস–বিষয়ক সংস্থাটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ডা. সুরঞ্জন ইএএসবির সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ সময় পথিকৃৎ চিকিৎসক প্রয়াত ডা. বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন তিনি। কিশোরী বয়সী মেয়েদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় সচেতনতা খুব জরুরি বলে মনে করেন তিনি। এই রোগের সঠিক কারণ আজও নিরূপণ করা যায়নি৷ কিন্তু রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে, তার লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে বন্ধ্যাত্ব ও অন্যান্য জটিলতা কমানো যায় বলে তিনি মনে করেন।
অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বলেন, ‘রোগীরা সব সময়ই পেটব্যথা, মাসিকের সময় মাথাব্যথা বা স্রাবের অভিযোগ নিয়ে আসছে। সেইমতো তাদের চিকিৎসা চলছে। কিন্তু এভাবে অল্প বয়সেই এন্ডোমেট্রিওসিসের কষ্টদায়ক লক্ষণগুলো চিনে নিয়ে এই রোগ ডায়াগনোসিস করা খুব জরুরি। ইএএসবির মাধ্যমেই এখন তা করা হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে সঠিকভাবে রোগ নিরূপণ করে দ্রুত চিকিৎসা নিলে পরবর্তী জটিলতা অনেকটা কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।’
ডা. শারমিন আব্বাসি জানান, গার্মেন্টসকর্মী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান—এমন আলাদাভাবে অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব দিয়ে এই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ইএএসবির তরফ থেকে।
সংস্থাটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী বলেন, ‘স্কুলপড়ুয়া কিশোরী, তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা, তাদের পরিবার, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দীর্ঘ দুই বছর কাজ করে ডায়াগনোসিসের দিক থেকে বেশ এগিয়ে গেছে ইএএসবি। কিশোরী, তরুণী ও ৪০ বছরের কম বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে জটিলতা থাকলেও সার্জারি না করে আগে ওষুধের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দেওয়া হয়।’
তবে জাতীয় উপদেষ্টা, অধ্যাপক ডা. লায়লা আর্জুমান্দ বানু জানান, বন্ধ্যাত্বসহ অতিরিক্ত সমস্যা ও জটিলতা থাকলে শল্যচিকিৎসা বা সার্জারি প্রয়োজন হয়। তবে সিস্ট অনেক সময় ওষুধে ভালো হয়। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কয়েক মাস ওষুধ খেতে হয়৷ সার্জারি করতে হলে প্রথমেই দক্ষ সার্জন নির্বাচন করতে হবে৷
এরপর আলোচনায় যুক্ত হন কলকাতার চিকিৎসক প্রদীপ কুমার মিত্র। শুরু থেকেই ইএএসবিকে দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে আসছেন তিনি। ডা. প্রদীপ জানান নাম গোপন রেখে কীভাবে স্ক্রিনিং করে তাঁরা স্কুলপর্যায়ে প্রাথমিক স্টেজের এন্ডোমেট্রিওসিস রোগী শনাক্ত করেছেন। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিলেন তিনি। এরপর সংস্থাটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দেশের প্রথম টেস্টটিউব বেবির রূপকার ডা. পারভীন ফাতেমা এন্ডোমেট্রিওসিস ও বন্ধ্যাত্ব নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জটিল এন্ডোমেট্রিওসিস ও বন্ধ্যাত্বজনিত সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের স্টেজিং করে তারপর যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
ইএএসবির এডিটর অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা এ পর্যায়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরে রোগের ফিরে আসার (রিকারেন্স) ব্যাপারে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘কিছু ওষুধ এই রোগের পুনরাবৃত্তিকে অনেকটা পিছিয়ে দিতে খুবই কার্যকর। কিন্তু সব ওষুধ এ দেশে সুলভে মেলে না৷ আবার অদক্ষ হাতে সার্জারি করলে অবশিষ্ট টিস্যুর কারণে এই রোগের ফিরে আসা ত্বরান্বিত হতে পারে।’
দর্শকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানান, জন্মবিরতিকরণ পিলের মাধ্যমে কিশোরী মেয়েদের চিকিৎসা করলে ভয়ের কিছু নেই। অনেক সময় অনেক ওষুধ দীর্ঘদিন নিলে উপকার পাওয়া যায়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগের ধরন ও পর্যায় বুঝে ওষুধ ও সার্জারি করেন চিকিৎসকেরা৷ তবে আলোচনায় অংশ নেওয়া চিকিৎসকদের সবাই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি নির্ণয়ের ওপর জোর দেন৷ তাঁরা সবাইকে এই আশার বার্তা দেন যে সবাই মিলে কাজ করলে, আরও সচেতন হলে এন্ডোমেট্রিওসিস ও অ্যাডিনোমায়োসিসের কষ্ট ও জটিলতা অনেকটাই উপশম করা সম্ভব।