কুমিল্লার মেয়ে শারমিন আক্তার। নানা-দাদাবাড়ির আদরে-আহ্লাদে বেড়ে ওঠা শারমিনের জীবন বদলে গেল বিয়ের পর। দুবার গর্ভপাত হলো। ধরা পড়ল কিছু শারীরিক সমস্যা। চিকিৎসা করিয়ে যখন আবার মাতৃত্বের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, তখনই জীবনে এল আরেক ঝড়। ধরা পড়ল স্তন ক্যানসার। স্তন ক্যানসার সচেতনতা মাসের ধারাবাহিক আয়োজনে আজ রইল তাঁর গল্প।

আগে থেকেই শিশুদের খুব ভালোবাসেন শারমিন। ২০১৭ সালে বিয়ের পরপরই গর্ভধারণ করেন। তবে খুব দ্রুতই গর্ভপাত হয়ে যায়। সন্তানের আকাঙ্ক্ষা থেকে ২০২০ সালে গর্ভধারণের পর আবার গর্ভপাত হয় শারমিনের। শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা চলছিল স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে। সেরেও উঠছিলেন। তবে বেশ কয়েক বছর পরও সন্তান না হওয়ায় নানা মানুষের কথার আঘাতে জর্জর হচ্ছিলেন। যদিও স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকদের এ নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাস। শারমিনের বয়স তখন ২৯। হঠাৎ একদিন স্তনে চাকা অনুভব করলেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করা হলো বায়োপসি। ধরা পড়ল ক্যানসার, স্টেজ টু। দেশে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলেন। সবাই জানান, জীবন বেঁচে গেলেও শারমিন হয়তো কোনো দিন মা হতে পারবেন না। শুনে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।
প্রবাসী স্বামী শারমিনের ক্যানসারের কথা শুনেই দেশে ছুটে আসেন। পাশে থেকেছিলেন পুরো লড়াইয়ে, রাতের পর রাত জেগে শুশ্রূষা করেন স্ত্রীর। তিনি শারমিনকে নিয়ে ভারতে যান। সেখানেই হয় অস্ত্রোপচার। অধ্যাপক ডা. সুরেশ হরিরাম আদভানি এবং ডা. গর্বিত চিতকরার উৎসাহে শারমিন তত দিনে ইতিবাচক হতে শিখে গেছেন। অস্ত্রোপচার শেষে জ্ঞান ফেরার পর শারীরিক সব কষ্ট চেপে স্বামীকে বলেছিলেন তাঁর চুল বেণি করে পরিপাটি করে দিতে।
দেশে ফিরে শারমিনের চিকিৎসার বাকি ধাপ চলে স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডে, ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. অরুনাংশু দাসের তত্ত্বাবধানে। ২০২৩ সালে সম্পন্ন হয় চিকিৎসা। একেকটা কেমোথেরাপির পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত বিছানা থেকে ওঠার মতো শারীরিক অবস্থাও থাকত না তাঁর। সুন্দর চুলগুলো পড়ে যাচ্ছে, ভ্রু পড়ে যাচ্ছে।
মনও খারাপ হতো। তবে চিকিৎসকের কথায় নতুনভাবে উৎসাহ পেতেন। ইতিবাচক থাকতে চেষ্টা করতেন। মজার ব্যাপার হলো, রেডিওথেরাপির সময় তিনি হাসপাতালে যেতেন সেজেগুজে! এমনকি রেডিওথেরাপি শেষে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে কনসার্টেও যোগ দিয়েছেন এই সাহসী নারী। বলছিলেন, ‘ডা. অরুনাংশু দাস আমার অনুপ্রেরণা। আগে ওনার খোঁজ পেলে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতাম না।’
নিজের ‘রোগী’জীবনে ক্যানসারে আক্রান্ত বহু মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন শারমিন। শ্বশুরবাড়িসহ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের পাশে পেয়েছেন নিজে। উপলব্ধি করেছেন, মনের জোর আর কাছের মানুষদের সমর্থন ছাড়া ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়া কঠিন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নেন তিনি। কেউ সাহায্য চাইলে তাঁকে বলেন কীভাবে কী করলে সবচেয়ে ভালোভাবে বিষয়টা সামলানো যেতে পারে। চিকিৎসার সব ধাপ পেরিয়ে এখন মা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন শারমিন। তাঁর বিশ্বাস, জীবনে যত বিপদই আসুক, স্বপ্নেরা কখনো হারায় না।