
চশমা আসলে কেন প্রয়োজন, কাদের দরকার, কিছুদিন ব্যবহার করার পর কি চশমা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে—এ রকম নানা প্রশ্ন আমাদের মনে আসে। আসুন, এ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করি
আমরা চোখ দিয়ে দেখি ঠিকই, তবে আমাদের দেখা সম্পূর্ণ করে মস্তিষ্ক। সহজ করে বললে, চোখ হলো দেখার যন্ত্র, আর সেই ছবি বোঝার কেন্দ্র হলো মস্তিষ্ক।
বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করি। আমাদের দেখার কাজটি কয়েকটি ধাপে হয়ে থাকে। প্রথমে কোনো বস্তু থেকে আলো এসে চোখে পড়ে এবং চোখের স্নায়ুর স্তর বা রেটিনায় ফোকাস বিন্দু তৈরি করে। ফলে রেটিনা উজ্জীবিত হয়ে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বা সংকেত তৈরি করে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়। মস্তিষ্ক তখন বস্তুটির ছবি তৈরি করে এবং আমরা জিনিসটা দেখতে পাই। তাই কোনো কারণে ফোকাস ঠিকমতো রেটিনায় না হলে দেখার বিষয়টি বিঘ্নিত হয়। এটিই রিফ্র্যাকটিভ এরর বা দৃষ্টির সমস্যা। এটি দুই ধরনের:
এ ক্ষেত্রে দূরের বস্তু দেখতে অসুবিধা হয়ে থাকে। মায়োপিয়া বা দূরদৃষ্টিসমস্যা সাধারণত মাইনাস পাওয়ারের লেন্স বা চশমা ব্যবহার করতে হয়। এখানে মাইনাস লেন্সের কাজ হলো, ফোকাল পয়েন্টকে পেছনে সরিয়ে রেটিনায় পৌঁছে দেওয়া।
হাইপার মেট্রোপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টিসমস্যায় দূরের বস্তু দেখার সমস্যার পাশাপাশি কাছের জিনিস দেখতে, যেমন পড়াশোনা করতে অসুবিধা হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত প্লাস পাওয়ারের লেন্স ব্যবহার করতে হয়। প্লাস পাওয়ারের লেন্সের কাজ হলো, ফোকাল পয়েন্টকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে রেটিনায় ঠিক জায়গামতো পৌঁছে দেওয়া।
এই দুটি সমস্যার বাইরেও আরও একটি দৃষ্টিসমস্যা আছে যাকে সহজ বাংলায় বলে চালশে। চল্লিশ বছর বা তার আশপাশের বয়সসীমায় কাছের বস্তু দেখতে অসুবিধা হয় বা পড়াশোনা, সেলাই ইত্যাদি কাজে ব্যাঘাত ঘটে। এটিকে বলা হয় প্রেসবায়োপিয়া। এখানেও প্লাস পাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হয়।
সরাসরি ঠিক কী কারণে দৃষ্টিসমস্যা হয়, তা নিয়ে কিছু কিছু মতবিরোধ আছে। তবে কিছু ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের কথা বলা যায় যেগুলো দৃষ্টিসমস্যার জন্য দায়ী বা দৃষ্টিসমস্যায় ভূমিকা রাখে।
পারিবারিক প্রভাব।
জাতি–গোত্র ইত্যাদির প্রভাব।
পরিবেশের প্রভাব। দীর্ঘ সময় কাছের কাজ করা যেমন পড়াশোনা, ছবি আঁকা ইত্যাদি। এসব কাজকে বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিসমস্যার কারণ বলে মনে করা হয়। তবে পারিবারিক প্রভাব ও জাতি, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি প্রভাবের তুলনায় পরিবেশের ভূমিকা খুবই নগণ্য।
বাইরে খেলাধুলায় সময় ব্যয় না করাও দৃষ্টিসমস্যায় ভূমিকা রাখে।
দূরের বস্তু ঝাপসা দেখা।
অনেক সময় শিশুরা খুব কাছ থেকে টিভি দেখে বা ক্লাসে বোর্ডের কাছে না বসলে দেখে না।
পড়তে পড়তে লেখা ঝাপসা হয়ে আসে।
চোখব্যথা বা মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা–পোড়া ইত্যাদি।
দৃষ্টিসমস্যা শনাক্ত হলে চোখের ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করে চশমা দেবেন।
নিয়মিত চশমা ব্যবহারে চোখের পাওয়ার ঠিক হয়ে যায়।
একদম না। চশমার সঙ্গে দৃষ্টি ভালো হওয়া বা না–হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। দৃষ্টিসমস্যা তার নিজস্ব নিয়মে চলতে থাকে।
ছোট মাছ, শাকসবজি ইত্যাদি খায় না বলে শিশুটির দৃষ্টিসমস্যা হয়েছে।
বিষয়টি আসলে তেমন নয়। ছোট মাছ বা শাকসবজির সঙ্গে দৃষ্টিসমস্যা বা রিফ্র্যাকটিভ এররের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ছোট মাছ বা শাকসবজি অথবা ভিটামিন–এ ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাবার রেটিনাকে সুস্থ রাখার জন্য জরুরি; সেটি ভিন্ন বিষয়।
একবার চশমা ব্যবহার করলে আর চশমা ছাড়া যায় না।
বিষয়টি একদম উল্টো। বিশেষ করে শিশুদের যত দ্রুত দৃষ্টিসমস্যা শনাক্ত করে চশমা দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল। চোখে সমস্যা আছে কিন্তু শিশু চশমা ব্যবহার করে না, এমন অবস্থায় শিশুর দৃষ্টি পরিণত না হয়ে অ্যাম্বলিওপিয়ার মতো সমস্যা সৃষ্টি করে। এ সমস্যাকে অলস চোখও বলা হয়। অ্যাম্বলিওপিয়া বা অলস চোখ হলো ট্যারা চোখের অন্যতম কারণ। এ দুটি ভয়াবহ পরিস্থিতি এড়াতে যখনই দৃষ্টিসমস্যা শনাক্ত হবে, তখনই চশমার ব্যবহার শুরু করতে হবে।
নতুন পাওয়ার ও পুরোনো পাওয়ারের চশমা একসঙ্গে ব্যবহার করা যাবে না।
নিয়মিত ব্যবহার করলে খুব তাড়াতাড়ি চশমার সঙ্গে চোখ অভ্যস্ত হয়ে যাবে।
বাইফোকাল (এই চশমার দুটি ভাগ থাকে—ওপরের ভাগটি দূরদৃষ্টি ঠিক করে আর নিচের অংশটি নিকটদৃষ্টি ঠিক করে) ও প্রগ্রেসিভ পাওয়ারে কোন অংশ দূরের জন্য আর কোন অংশ কাছের বা মধ্যবর্তী দূরত্বের জন্য, এটি একটু খেয়াল রাখতে হবে। মানিয়ে ওঠার সমস্যা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি মানিয়ে যায়।
চশমা ঠিকঠাক না হওয়ার জন্য প্রধানত দুটি বিষয় দায়ী—ফ্রেম অথবা ফিটিং। সব ফ্রেম সব চেহারার সঙ্গে যায় না। পাওয়ারের অতিরিক্ত কিছু পরিমাপ আছে, যেগুলো যথাযথ না হলে সাময়িক কিছুটা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ২ থেকে ৩ সপ্তাহ চশমা ব্যবহারে ধীরে ধীরে এটি ঠিক হয়ে যায়।
ফ্রেমটি মুখাবয়বের সঙ্গে মানানসই হওয়া প্রয়োজন।
রিম বা গ্লাস বড় না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাইফোকাল বা প্রগ্রেসিভ পাওয়ারের চশমার বেলায় গ্লাস বা রিম স্বাভাবিক বা একটু বড় হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
ফ্রেমটি খুব সহজে নাকে বসতে হবে এবং কানের পাশে সামান্যতমও চেপে থাকা চলবে না।
ভারী চেহারায় মোটা বা ভারী ফ্রেম মানানসই হলেও মানিয়ে নেওয়ায় সমস্যা থাকলে হালকা ফ্রেমই ভালো।
লাসিক একধরনের কর্নিয়ার অপারেশন যা লেজার রশ্মির মাধ্যমে কাটাছেঁড়া না করে সম্পন্ন করা হয়। এখানে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের সাহায্যে লেজার প্রয়োগ করে কর্নিয়ার বক্রতা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। সবার বেলায় ল্যাসিক প্রযোজ্য নয়। ল্যাসিকের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এটি সম্পূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়। ল্যাসিক–পরবর্তীকালে দীর্ঘ মেয়াদে অনেকের চোখে টিয়ারস্বল্পতা বা ড্রাই আইয়ের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ল্যাসিক–পরবর্তী সময়ে অনেককেই দীর্ঘ মেয়াদে আর্টিফিশিয়াল টিয়ার ব্যবহার করতে হয়।
অধ্যাপক ডা. মো. ছায়েদুল হক, বিভাগীয় প্রধান, মার্কস মেডিকেল কলেজ, মিরপুর, ঢাকা