১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় এসেছেন মাসতুরা খানম। ১৯৭১ সালে হারিয়েছেন স্বামী মীর আবদুল কাইয়ূমকে। তাঁর জীবনের সংগ্রাম নিয়ে এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শঞ্চস্থ হয়েছে নাটক। নিজের জীবন নিয়ে নাটক দেখেছেন দর্শকসারিতে বসে

ছোট মেয়ে মারুফা কানিজের বয়স তখন তিন বছর। বৃষ্টি এলেই বলত, ‘বাবা কোথায়, ভিজে যাচ্ছে না!’ ও হাত–পা মেলে দিয়ে কাঁদতে শুরু করত। বড় মেয়ে মাহবুবা কানিজের বয়স পাঁচ বছর। ও চুপ করে থাকত। কোনো কথা বলত না। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই কাঁদতে শুরু করত। টানা এক ঘণ্টা ধরে কাঁদত। বড় ছেলে কাঁদত না। শুধু জামার প্রথম বোতামটা কামড়াত। আর বাবাহীন পৃথিবীতে যে ছেলেটা এল, সে দুই বছর কোনো কথা বলল না। কীভাবে যে দিন যায়! পাকিস্তানি সেনারা বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে ছেলেমেয়েদের কী অবস্থা হয়েছিল, তাই বলছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মীর আবদুল কাইয়ূমের স্ত্রী মাসতুরা খানম।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়ূমকে একাত্তরের ২৫ নভেম্বর পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ৩০ ডিসেম্বর রাজশাহী নগরের শ্রীরামপুর এলাকায় বাবলাবন বধ্যভূমিতে কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়। সে সময় তাঁর ছোট ছেলে মাসতুরা খানমের পেটে ছিলেন। মাসতুরা খানম সেই ছেলের কাছে আমেরিকায় ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আয়োজনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে তিনি রাজশাহীতে এসেছিলেন। তাঁর বড় মেয়ে মাহবুবা কানিজ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি। শুক্রবার সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় বসে কথা হয় এই পরিবারের সঙ্গে। সেখানে তাঁর জামাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মুশফিক আহমদও ছিলেন।
মাসতুরা খানম স্বামীর সহকর্মী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। সে সময় তাঁরা রাজশাহী নগরের মালোপাড়া এলাকায় ‘লাবণ্য ভবন’ নামের একটি বাসায় থাকতেন। তাঁর স্বামী ‘স্টুডেন্টস অ্যাটিচুড টুওয়ার্ডস পলিটিকস ইন ইস্ট পাকিস্তান’ বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি এ বিষয়ে বাংলায় প্রশ্নপত্র প্রমিতকরণ করে সাড়ে ৪০০ শিক্ষার্থীর ওপর প্রয়োগ করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররাজনীতির ওপরে এই গবেষণার জন্যই তিনি পাকিস্তানিদের টার্গেট হয়েছিলেন। সে কারণে যুদ্ধ শুরুর আগেই মার্চের শুরুতে বাসার তিনতলার ছাদ থেকে বন্দুক দেখানোর অভিযোগ এনে মীর আবদুল কাইয়ূমকে মিলিটারিরা ডেকে নিয়ে যায়। জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে ছেড়েও দেয়। সে সময় বাঙালি সেনারা তাঁকে সাবধানে থাকতে বলেছিলেন।
এর কিছুদিন পরে তাঁরা গ্রামে চলে যান। জুনের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাজে যোগদান করতে বললে ফিরে এসে দেখেন লাবণ্য ভবন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দেয়ালের সঙ্গে লাগানো একটি আলমারি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
মাসতুরা খানম পরিবার নিয়ে ঘোড়ামারা এলাকায় বাবার বাড়িতে ওঠেন। সেই বাড়ি থেকেই ২৫ নভেম্বর তাঁর স্বামী মীর আবদুল কাইয়ূমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের স্টেনোগ্রাফার তৈয়ব আলী ডেকে নিয়ে যান। সেনাবাহিনীর জিপে তুলে দিয়ে আসার পরে আবার বাড়িতে এসে বলে যান, ‘স্যাররা নিয়ে গেলেন। আবার চলে আসবেন।’
মাসতুরা খানম বললেন, বিশ্বাস হচ্ছিল না, তিনি সত্যিই আর আসবেন না। আমি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে পাকিস্তানিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে স্বামীকে খুঁজতে গিয়েছিলাম। ওরা বলল, এ নামের কাউকে আমরা ধরে আনিনি। কেউ বলেছেন, নাটোরে দেখেছেন। কিন্তু তিনি আর আসেননি।’
তিনি আক্ষেপ করে বললেন, ‘এই শেষ নয়, স্বাধীন দেশে শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে বিব্রত হতে হয়েছে। মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান (এখন সভাপতি বলা হয়) মতিয়ুর রহমান ছিলেন অবাঙালি রাজাকার। তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যায় সহায়তাকারী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি পালিয়ে পাকিস্তানে চলে যান। তিনি যাওয়ার পর আরেকজন সহায়তাকারী অবাঙালি শিক্ষক ওয়াসীম বাগী প্রধান হলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁদের সাসপেন্ড করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। সে সময় ওয়াসীম বাগীর স্ত্রী তাঁর স্বামীকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আমার বাসায় এসে কত কাকুতিমিনতি করছিলেন। এমনকি আমার ছোট ছেলেকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সেদিন আমি আমার ছেলেকে নিতে দিইনি। কারণ, ৩০ ডিসেম্বর ওর বাবার লাশ পাওয়া গেল। ২৯ ফেব্রুয়ারি ছেলে হলো। ছেলেটা কোনো দিন বাবাকে দেখতে পাবে না। যে ছেলের বাবাকে ওর স্বামীরাই সহযোগিতা করে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিল, আর সেই ছেলেকে কোলে নিতে এসেছে। আমি দিতে পারিনি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা ক্ষমা না করলেও তাঁরা কীভাবে জেল থেকে বেরিয়ে নিজের দেশে চলে গেলেন। এমনকি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমার মেয়ে ওই বিভাগের সভাপতি হওয়ার আগপর্যন্ত সাবেক সভাপতিদের ছবির সঙ্গে মতিয়ুর রহমানের ছবিও ঝোলানো ছিল। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই সেই ছবি পরে নামানো হয়েছিল।
আরও অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে মাসতুরাকে। তিনি সেসব বলে চলেন, ‘একদিন রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে সেই স্টেনোগ্রাফার তৈয়ব আলীর সঙ্গে দেখা। তাকে দেখার পর মনে হলো আমি যেন পড়ে যাচ্ছি। ও তাড়াতাড়ি করে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। যে ব্যক্তি বাড়ি থেকে আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে মিলিটারিদের হাতে তুলে দিল, সে বহালতবিয়তে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছে! শুধু তা–ই নয়, চাকরি করে অবসরসুবিধা নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন কাটিয়েছে। রাকসু থেকে আমাকে ও শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দারের স্ত্রী চম্পা সমাদ্দারকে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। সেদিন আমি বলেছিলাম, কয়েকটি ইটের এই ভিত্তিপ্রস্তর কালকে থাকবে তো! যথারীতি তাই হলো। আমার কথাটাও আবার খবরের কাগজে বের হয়েছিল। এটা দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, পরে যিনি উপাচার্য হয়েছিলেন, আমাকে শুনিয়ে বললেন, “ওটা যে ভেঙে ফেলা হবে। উনি জানলেন কী করে?” কত বড় ঔদ্ধত্য! আমি এ ধরনের মন্তব্য সহ্য করতে পারিনি। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেছিলাম।’
৫০ বছর ধরে বয়ে বেড়ানো এই শোক মাসতুরা খানম আঘাতে আঘাতে হয়তো অনেকটা সয়ে নিয়েছেন, কিন্তু কিছু কথা না বলে থাকতে পারলেন না। বললেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলাম বলে চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পেরেছি। শহীদ মীর আবদুল কাইয়ূমের বিমার কিস্তি কেটে নিলেও বিমার টাকাটা বিশ্ববিদ্যালয় দিল না। তারা সাফ জানিয়ে দিল, ‘ইনস্যুরেন্স ওয়ার কাভার করে না।’ সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকটা করা হয়েছে, তাতে যে ভাস্কর্যটা বানানো হয়েছে, তা দেখে কোনো দিক থেকেই মীর আবদুল কাইয়ূমকে চেনা যায় না। হবিবুর রহমান ও সুখরঞ্জন সমাদ্দার—কাউকেই চেনা যায় না। এভাবে কি আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁদের আড়াল করে ফেলছি না?’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করা হয়েছে গত বছর। আরও একটি বছর চলে গেল, মাসতুরা খানমের মনের এই দুঃখ এখনো কাটে না।