কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন যেকোনো শিক্ষার্থীর কাছেই খুব বিশেষ একটা দিন। গাউন পরব, বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তুলব, আকাশে উড়িয়ে দেব সমাবর্তনের হ্যাট—এমন একটা ছবি কল্পনা করেন অনেকেই। দিনটা আরও বিশেষ হয়ে ওঠে, যদি সঙ্গে থাকেন মা-বাবা। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলতে গিয়ে হয়তো সিনেমার মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা দিনগুলো। আজ মা দিবসে সেসব দিনের স্মৃতিচারণা নিয়ে সন্তানদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে স্বপ্ন নিয়ে পাতায়। এখানে পড়ুন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির পিএইচডি শিক্ষার্থী তাসমিয়াহ সাদ–এর লেখা।

একটা গল্প বলি। এক রাজকন্যা আর একজন রানির গল্প। রানি তখন সন্তানসম্ভবা। যেকোনো সময় রাজকন্যা আসবে—সেই স্বপ্নে বিভোর। রাজবৈদ্য অবশ্য বলেছেন, খানিক সময় এখনো বাকি। কিন্তু রাজকন্যা যে বেজায় চঞ্চল। সময়ের আগেই পৃথিবীর আলো দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় মায়ের কোলে সময়ের আগেই চলে আসার লোভ সামলাতে পারল না। কিন্তু ছোট্ট একটু সমস্যা হয়ে গেল। আগেভাগেই পৃথিবীতে চলে আসায় শিশু রাজকন্যার শরীর ছিল ভীষণ রোগা। খেতে চাইত না, ঘুমাতে চাইত না। অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকত। নতুন মা হয়ে রানিও দিশাহারা। সব সময় তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন রাজকন্যার পেছনে।
একটু একটু করে রাজকন্যা বড় হতে লাগল, শুরু হলো পড়াশোনার দিন। রানি ও রাজা মিলে স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের রাজকন্যা হবে আশপাশের দশ রাজ্যের রাজপুত্রের সমান। মা-বাবার মান রেখে স্কুল-কলেজ পেরিয়ে রাজকন্যাও পেয়ে গেল দেশসেরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ। তাতেও কি যুদ্ধ শেষ? আরও কত কী বাকি। একবার রাজকন্যা খুব অসুস্থ। রাজবৈদ্য সাফ সাফ বলে দিলেন, বাইরের খাবার গ্রহণ করা বারণ। রাজকন্যা ভাবল, এমন হলে তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করা যাবে না। রানি তখন বললেন, তুমি নিশ্চিন্তে ক্লাস করো। প্রত্যেক বেলার খাবার তিনি নিয়ে আসতে শুরু করলেন, ঠিক যেমন মা পাখি বাচ্চার জন্য খাবার নিয়ে আসে। রাজকন্যা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে নিজ বিভাগে পেল প্রথম স্থান। ভালো ফলের সুবাদে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগও দিল।
সেদিনের সেই শুকনা টিংটিঙে রাজকন্যা এখন রাজকুমারদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। পিএইচডি করবে বলে সে চলে এসেছে বিদেশে, রাজা-রানির কাছ থেকে অনেক দূরে!
যে রানির কথা বলছিলাম, তার নাম তাহমিনা বেগম। আমার মা। জানি না কেন তিনি সব সময় আমার ওপর আত্মবিশ্বাস রেখেছিলেন। সব সময় বইপড়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ভাবতে পারেন, ছোট্ট একটি মেয়ের সময়টা যেন একঘেয়ে না কাটে, সে জন্য মা গীতাঞ্জলি খুলে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে শোনাতেন। এভাবেই বড় করেছেন। রাত জেগে যখন পড়তাম, মা আমার পেছনে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়তেন, যদি মেয়ের মাঝরাতে ক্ষুধা লাগে!
আজ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপক। পিএইচডি করছি অস্ট্রেলিয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনের সময় মায়ের সঙ্গে ছবি তুলেছিলাম। পিএইচডির সমাবর্তনে হয়তো আবার একটা ছবি তোলা হবে। আপাতত মা আমার মুঠোফোনের চৌকোনা ভিডিও কলে বন্দী।
মা দিবসের শুভেচ্ছা, আম্মু।