টাঙ্গাইলের জমিদার যতীন্দ্র কুমার সাহা ঢাকায় এই বাড়িটি নির্মাণ করেন
টাঙ্গাইলের জমিদার যতীন্দ্র কুমার সাহা ঢাকায় এই বাড়িটি নির্মাণ করেন

জমিদার যতীন্দ্র কুমারের ঢাকার এই বাড়ি এখনো টিকে আছে

১৮৬৪ সালে যাত্রা শুরু করে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামত, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, পানীয় জলের সরবরাহ, আবর্জনা অপসারণের মতো কাজ শুরু করে। এ সময় রেলপথ ও নৌপথের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে।

বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ঢাকার সঙ্গে কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এই যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কারণে শহরের পরিধিও বাড়তে থাকে। নতুন নতুন এলাকায় গড়ে ওঠে বসতি।

সূত্রাপুর, লালবাগ, ওয়ারী, নারিন্দা বিকশিত হতে শুরু করে। অবশ্য বুড়িগঙ্গা নদীতীরবর্তী ফরাশগঞ্জ আগেই জমজমাট ছিল। কারণ, সেটা ছিল ফরাসি বণিকদের ব্যবসাকেন্দ্র। ইংরেজরা এ অঞ্চলে আসার আগে ফরাসি, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, আর্মেনীয়দের আধিপত্য ছিল।

মঙ্গলবাসের বর্তমান অবস্থা

ফরাশগঞ্জের পাশের জনপদই শ্যামবাজার। সে সময়, অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষ দিকে টাঙ্গাইলের জমিদার যতীন্দ্র কুমার সাহা ঢাকার এই শ্যামবাজারে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। নাম মঙ্গলাবাস।

ঢাকায় এলে এ বাড়িতেই থাকতেন জমিদার, হালের টাকাওয়ালা ব্যক্তিরা যেমন মূল বাড়ির বাইরে হলিডে হোম তৈরি করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগপর্যন্ত এ বাড়িতে তাঁর যাতায়াত ছিল। তবে যতীন্দ্র কুমারের জমিদারি টাঙ্গাইলে ছিল নাকি অন্য কোথাও, এ নিয়ে মতভেদ আছে।

দেশ বিভাগের সময় অনেকেই সম্পত্তি বদল করতে পেরেছিলেন কিন্তু যতীন্দ্র কুমার সাহা পারেননি। তিনি এ প্রাসাদ ফেলে রেখে কলকাতায় চলে যান।

বর্তমানে বাড়িটি ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে

ঢাকাবিষয়ক জীবন্ত ডিকশনারি হিসেবে পরিচিত আজিম বখশের ভাষ্য, ৩ নম্বর মোহিনী মোহন দাশ লেনে অবস্থিত মঙ্গলাবাসের পাশেই ছিল সরদার মাওলা বখশের বাড়ি। সেই শৈশব থেকেই বাড়িটি এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু সম্পর্কে অবগত তাঁর পুত্র মোহাম্মদ আজিম বখশ।

আজিম বখশ বললেন, দেশভাগের পর এ বাড়িতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা থাকতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে বাড়িটি লুটপাটের শিকার হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্রাবাস হয় বাড়িটি। শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাস হিসেবে শতবর্ষী ভবনটি ব্যবহৃত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন কবি নজরুল কলেজের এই শিক্ষার্থী।

পাশাপাশি নিচতলায় একটি কক্ষ ছেড়ে দেওয়া হয় সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তি খেলাঘর আসরের জন্য। শিশুসাহিত্যিক হাবীবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৫২ সালের ২ মে ঢাকায় ‘খেলাঘর’ প্রতিষ্ঠিত হয়। খেলাঘরের একটি শাখা ছিল

এই মুক্তি খেলাঘর আসর। আজিম বখশ স্মৃতি হাতড়ে বললেন, একটা শিশু সংগঠনের যেসব কাজ হয়ে থাকে, সবই ছিল খেলাঘর আসরের। কিন্তু কালক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ে সংগঠনটি।

রঙিন কাচের নকশা এখনো চোখে পড়ে

শ্যামবাজার, ফরাশগঞ্জের মানুষ এখনো ভবনটিকে খেলাঘরের ভবন হিসেবেই চেনেন। স্থানীয় কোনো চায়ের দোকানদার কিংবা ফুচকাওয়ালাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, মঙ্গলাবাস কোথায়, তাঁরা উত্তর দিতে পারবেন না। খেলাঘরের কথা বললে গলিটিও চিনিয়ে দেবেন।

পুরান ঢাকা নিয়ে লেখালেখি ও গবেষণার সুবাদে একাধিকবার যাওয়া হয়েছে এই মঙ্গলাবাসে। অতি সম্প্রতি এক বিকেলে আবার গেলাম।

একসময়ের জমজমাট এই জনপদে গেলে আপনার মন খারাপ হতে বাধ্য। শতবর্ষী অনেক ভবন সাক্ষ্য দিচ্ছে, অতীতে এখানকার দেয়ালে লেখা ছিল কতশত ঘটনার গল্প। প্রাণের কত স্ফূরণ ছিল। আজ যেন সব মুছে মলিন চেহারা ধরেছে।

মঙ্গলাবাস নিয়ে কেন এত আলোচনা

কাঠ ও লোহার ফ্রেম

মঙ্গলাবাস নিয়ে এত আলোচনার কারণ  স্থাপনাটির ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলী। বাইরে থেকে এটি দ্বিতল কিন্তু দোতলার দক্ষিণ দিকের কিছু অংশ ত্রিতল। এই তিনতলা ভবন আবার বর্তমান পাঁচতলার সমান।

ভবনটির সামনের দিকে যতটা জরাজীর্ণ মনে হয়, ভেতরে ততটা নয়। তিনটি সুদৃশ্য মুক্ত উঠান। একটি বেশ বড়। এখানে জমিদার যতীন্দ্র কুমার তাঁর পারিষদ নিয়ে বসতেন। আরেকটিতে বাড়ির নারীরা বিকেলবেলা সময় কাটাতেন। অন্যটির ব্যবহার সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায় না।

বাড়িটির পেছনে সেই আমলের গোসলের ব্যবস্থা হিসেবে কুয়া ছিল। এ আমলেও সেই কুয়া থেকে পানি তুলে গোসল চলছে। ভবনটির দেয়ালের কিছু অংশ ও কিছু ঘরে আগের আমলের টাইলস ব্যবহৃত হয়েছে।

সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠেই বিরাট আকাশ। জানা গেল, এই ছাদ ও নিচতলার উঠানে ধারণ করা হয়েছে চোরাবালি, মুসাফিরসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের দৃশ্য। নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কিছু বিজ্ঞাপনচিত্র।

কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বাড়িটি

সামান্য কিছু সংস্কার ছাড়া প্রাসাদটির আদি রূপ এখনো বর্তমান। তবে এই সংস্কারকাজ নিয়েও প্রশ্ন আছে কারও কারও। সংস্কারের নামে ভবনের মূল অবয়ব নষ্ট করার অভিযোগ উঠেছে কবি নজরুল সরকারি কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

এ নিয়ে ২০২০ সালের শেষ দিকে সেখানে মানববন্ধন করে আরবান স্টাডি গ্রুপ, যারা পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে কাজ করে। তাদের কথা, শতবর্ষী মঙ্গলাবাস ভবনটি কারুকার্যখচিত। এটি ইউরোপীয় নিও ক্ল্যাসিক্যাল স্টাইলে রেলিং ও রঙিন শার্সি দিয়ে নির্মিত।

শার্সি হলো কাঠ বা ধাতুর ফ্রেমে তৈরি জানালার শাটার বা পর্দা, যার মধ্যে রঙিন কাচ বসানো থাকে। এগুলো থেকে ভেতরে সূর্যালোক প্রবেশ করে বর্ণিল আলো ছড়ায়। বিশেষ করে দিনের বেলায় এ আলো ঘরের ভেতরে রঙিন ছায়া ফেলে। এটা বাড়ির সৌন্দর্য ও গোপনীয়তা—দুই-ই বজায় রাখত।

খুটির নকশা এখনো চোখে পড়ে

কিন্তু সংস্কারও দরকার। ভেতরে ভবনটিতে এখন শ দেড়েক শিক্ষার্থীর আবাস। এখানে মোট ঘর ৩৫টি। এক ঘর দিয়ে ঢুকে সব কক্ষে যাওয়া যায়। যেসব শিক্ষার্থী বাস করছেন, তাঁদের অবস্থা একেবারেই কাহিল। আস্তর খসে খসে পড়ে। অনেকেই মশারির ওপরে ত্রিপল টানাতে বাধ্য হয়েছেন।

কথা হলো আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তাইমুর ইসলামের সঙ্গে। তাঁর কথা, এটি নিও ক্ল্যাসিক্যাল স্টাইলে নির্মিত মাল্টিপল কোর্ট বা একাধিক উন্মুক্ত আঙিনাবিশিষ্ট ভবন। স্থাপত্যিক গুরুত্ব বা নান্দনিক গুরুত্বের কারণে ঢাকার প্রধান স্থাপনাগুলোর মধ্যে এ ভবন স্থান করে নিয়েছে।

স্থাপত্যিক গুরুত্ব বা নান্দনিক গুরুত্বের কারণে ঢাকার প্রধান স্থাপনাগুলোর মধ্যে এ ভবন স্থান করে নিয়েছে

ভবনটি কেন অনন্য, তাইমুর ইসলামের কথায় উঠে এল তা–ও। কিছুটা বৃত্তাকার সম্মুখ অবয়বটিতে নকশাসংবলিত খিলানের সারি আছে। যার ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে করিন্থিয়ান ক্যাপিটালবিশিষ্ট দোতলা সমান উচ্চতার বিশাল খাঁজকাটা কলাম। এই খিলানগুলোর ভেতরে ছিল স্টেইনড গ্লাসের ওপর নকশা করা মেটাল ফ্রেম।

ভেতরে চক মেলানো বারান্দায় রয়েছে হাতে করা অলংকরণ, নকশা করা লোহার পিলার, নকশা করা কাঠের ঝালর, প্রাচীন সিরামিক টাইলসের ব্যবহার। সবকিছু মিলে ভবনটি নান্দনিক দিক থেকে অনন্য।

দরকার সংরক্ষণ

সূত্রাপুর ও আশপাশের এলাকায় বেশ কয়েকটি ভবন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকায় রয়েছে, যেমন নর্থব্রুক হল, রোজ গার্ডেন, সূত্রাপুর জমিদারবাড়ি, রূপলাল হাউস, শঙ্খনিধি হাউস। তবে সে তালিকায় নেই মঙ্গলাবাস। অথচ এটি পুরান ঢাকার স্থাপত্য ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। পাশাপাশি এটি ইতিহাস ও সংস্কৃতিরও অংশ। এ ধরনের ভবন সংরক্ষণের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য রয়েছে।

(লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন ‘বর্ণিল বসত’ জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)