বায়োফিলিক ডিজাইন অন্দরসজ্জায় যেভাবে আনবেন

এখন মুঠোফোনের পর্দার আলোয় শুরু হয় আমাদের দিন। অফিস অথবা ক্লাসেও থাকতে হয় কৃত্রিম পরিবেশে। ছুটির দিন ছাড়া প্রকৃতির কাছাকাছি আসার খুব একটা সুযোগ আমাদের হয় না। কর্মব্যস্ত প্রযুক্তিনির্ভর এই জীবনে আমরা যে সবুজ প্রকৃতির কাছ থেকে দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছি, তা অস্বীকার করা যাবে না। এই বিচ্ছিন্নতা মানসিক চাপ, উদ্বেগ, একাকিত্ব এমনকি শারীরিক অসুস্থতার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিচ্ছে। জীবনকে করে তুলছে আরও একঘেয়ে, মলিন। এমনই এক অবস্থায় ঘরের ভেতরই প্রকৃতি সাজানোর বন্দোবস্ত করেছেন আধুনিক অন্দরসজ্জাবিদররা। অন্দরসজ্জার এই ধারাই বায়োফিলিক ডিজাইন নামে পরিচিত। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে পুনঃস্থাপন করার প্রয়াস থেকেই চালু হয়েছে অন্দরসজ্জার এই ধরন।

প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে পুনঃস্থাপন করার প্রয়াস থেকেই চালু হয়েছে বায়োফিলিক ডিজাইনের
ছবি : সুমন ইউসুফ

‘বায়োফিলিয়া’ শব্দটি প্রথম জনপ্রিয় করেন জীববিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইলসন। তাঁর মতে, মানুষের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি সহজাত আকর্ষণ রয়েছে। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বায়োফিলিক ডিজাইন। এটি এমনভাবে নকশা করা হয়, যাতে মানুষ ঘরের মধ্যেই সবুজ প্রকৃতির উপস্থিতি অনুভব করতে পারে।

বায়োফিলিক ডিজাইনে যেসব দিক খেয়াল রেখে করা হয় 

প্রাকৃতিক আলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার

বায়োফিলিক ডিজাইনের একটি প্রধান উপাদান হলো প্রাকৃতিক আলো। এর মূল লক্ষ্য থাকে, ঘরের ভেতরে যতটা সম্ভব সূর্যের আলো প্রবেশ করানো। এই সজ্জায় দেয়ালে বা ছাদে বড় কাচের জানালা, ঘুলঘুলি ও স্বচ্ছ বিভাজক ব্যবহার করা হয়। ফলে ঘরের উজ্জ্বলতা বাড়ে। সূর্যের আলোয় সেরোটোনিন বা হ্যাপিনেস হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে, তাই মানুষের মনও প্রফুল্ল থাকে। এর ফলে ঘুমের গুণগত মানও উন্নত হয়।

বায়োফিলিক ডিজাইনের একটি প্রধান উপাদান হলো প্রাকৃতিক আলো

প্রাকৃতিক উপকরণ ও আমেজের ব্যবহার

বায়োফিলিক ডিজাইনে ঘরের আসবাব, দেয়াল, মেঝে বা ছাদে কাঠ, পাথর, বাঁশ, মাটি ও গাছের শেকড় দিয়ে তৈরি উপকরণ ব্যবহার করে প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করা হয়। এমনকি টাইলসেও ব্যবহার করা হয় কাঠ, মাটি বা পাথুরে আমেজ যা যান্ত্রিক জীবনে এনে দেয় প্রকৃতির ছোঁয়া। যেমন কাঠের মেঝে উষ্ণতা ও স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়, প্রাকৃতিক পাথরের বাথরুম বা রান্নাঘর একই সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন ও টেকসই, হাতে বোনা পাটের গালিচা বা বাঁশের পর্দা ঘরের পরিবেশকে শান্ত–স্নিগ্ধ করে।

বাড়ির ভেতর গাছপালা

ঘরের মধ্যে ছোট বা মাঝারি গাছ যেমন মনস্টেরা, স্পাইডার প্লান্ট, মানিপ্লান্ট, ফার্ন, পিস লিলি ইত্যাদি রাখলে তা শুধু ঘরের সাজসজ্জাই নয়, বরং বায়ুর মানও উন্নত করে। ঘরে যত সবুজ থাকে, ততই চোখে আরাম পাওয়া যায়। ইনডোর প্লান্ট ঘরের কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করে। আর্দ্রতার ভারসাম্য বজায় রাখে। চারপাশের সবুজ গাছ চোখের ক্লান্তি কমাতেও সাহায্য করে।

অন্দরে গাছের সমারোহ বায়ুর মানও উন্নত করে

সবুজ দেয়াল

সবুজ গাছের স্তর দিয়ে সাজানো দেয়ালকে বলা হয় লিভিং ওয়াল বা সবুজ দেয়াল। এ ধরনের দেয়ালে জীবন্ত গাছপালা সেঁটে দেওয়া থাকে। গাছপালা উল্লম্বভাবে দেয়ালে মিশে থাকে বলে একে উল্লম্ব বাগান বা ভার্টিক্যাল গার্ডেনও বলা হয়। এতে করে তৈরি হয় একটি শীতল পরিবেশ। দেয়ালে গাছের স্তর থাকার ফলে তা শব্দ শোষণ করে কমায় শব্দদূষণ। এটি দেয়ালের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে।

অ্যাট্রিয়াম বা খোলা স্থান

ভবনের ভেতর খোলা ছাদ বা অ্যাট্রিয়াম বায়োফিলিক ডিজাইনের অন্যতম উপাদান। বাড়িতে এই বিশেষ খোলা স্থান এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যেন সূর্যের আলো, বাতাস ও গাছপালা একত্রে উপস্থিত থাকে। অফিস বা বাড়িতে এমন জায়গা কর্মী বা বাড়ির বাসিন্দাদের মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। এ ছাড়া এটিকে কমন স্পেস করা হলে সেখানে খোলা হাওয়ায় মানুষ বসে প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতে পারে।

বাড়িতে এমন জায়গা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়

জলধারা ও বহমান পানি

বায়োফিলিক ডিজাইনে ঘরের ভেতরে ফোয়ারা বা ছোট জলপ্রপাতের মতো উপাদান যোগ করা হয়। পানি প্রবাহিত হওয়ার শব্দ ঘুম ও মনোযোগ আনতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। বহমান পানির কলতান মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়িয়ে ভালো অনুভূতি সৃষ্টি করে। তাই প্রাকৃতিক অন্দরসজ্জায় এর ভূমিকা বেশ।

কেন বায়োফিলিক ডিজাইনে সাজাবেন বাড়ি

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে বসবাস করলে ব্যক্তির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। কাজে উদ্যম আসে। কমে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ। এমনকি বাড়িতে প্রাকৃতিক আবহ তৈরি করলে তা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করে। শিশুদের মধ্যে মনোযোগ ও শেখার দক্ষতা বৃদ্ধি পায় যদি সে সবুজের ভেতর বেড়ে ওঠে। বর্তমান নাগরিক জীবনে বায়োফিলিক ডিজাইন কোনো বিলাসিতা নয়, বরং এটি মানুষের মানসিক, শারীরিক ও আবেগীয় সুস্বাস্থ্যের জন্য দরকারি প্রাকৃতিক পন্থা। শহুরে যান্ত্রিক জীবনে প্রকৃতির অনুপস্থিতি আমাদের যেভাবে প্রভাবিত করছে, তার সমাধান দিতে পারে অন্দরসজ্জার এই ধরন।

সূত্র: দ্য ইন্টেরিয়র ডিজাইন ইনস্টিটিউট