২ কাঠা জমিতেই আমাদের স্বপ্নের বাড়ি

ঘরে বসে আকাশ দেখার জন্য এভাবে ছাদের নকশা করা হয়েছে
ছবি: কবির হোসেন

বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর নিজেদের জমানো সঞ্চয়ে ঢাকার মিরপুরের আনসার ক্যাম্প এলাকার মধ্য পাইকপাড়ায় দুই কাঠার একখণ্ড জমি কেনেন সাখাওয়াৎ হোসেন–ফাতেমা খাতুন দম্পতি।

সাখাওয়াৎ শহরের নামকরা সরকারি স্কুলের শিক্ষক আর ফাতেমা সংসার আগলে রাখা গৃহিণী। তিনটি সন্তান নিয়ে ভাড়াবাড়ির ভাসমান দিনগুলোতে তাঁরা খুঁজে বেড়িয়েছেন স্থিরতা। একসময় সেই স্বপ্ন গিয়ে থামে নিজেদের কেনা জমির বুকজুড়ে, সেখানে তাঁরা গড়ে তোলেন একতলা একটি বাড়ি। ইটের গাঁথুনির দেয়াল আর টিনের ছাদের নিচে তাঁদের বাবুইপাখির বাসা। অট্টালিকা নয়, তবু আপন আশ্রয়। আর সে আশ্রয়ের নাম, হার না মানা এক ফুলের নামে—অপরাজিতা।

গলির শেষ বাড়ি হওয়ায় অপরাজিতার সামনের সরু রাস্তাটিই হয়ে ওঠে উঠান। সেই উঠানে সবজির লতাগুল্ম যেন সম্পর্কের শিকড় বিস্তার করে। কখনো লাউ, ঝিঙে; কখনো কুমড়ো, পটোল—একেকটি যেন একেক ঋতুর চিঠি। বাড়ির আশপাশে নানা ফুলের গাছ ছিল, জানালা খুললেই চোখে পড়ত কচুপাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু—টলটলে, শান্ত।

বাড়ির আঙিনায় আরও ছিল নারকেল আর সুপারিগাছ। ক্লান্ত দুপুরে বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ঘিরে কখনো সুপারি কুড়াত কেউ। কারোবা ভাতঘুম ভেঙে যেত টিনের চালে নারকেল পড়ার শব্দে।

বৃষ্টি এলেই টিনের চালে শুরু হতো রিমঝিম শব্দ, ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ত একধরনের প্রশান্তি। সেই শব্দে ঘুম আসে, ভাবনায় ছুটি মেলে। জানালার পাশে বসে এক কাপ চা নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যেত একটা মেঘলা দিন।

ঘর শুধু ঘর ছিল না

 এ বাড়ির মানুষগুলো বন্ধুপ্রিয়। অতিথি সমাদরে তাঁদের জুড়ি মেলা ভার। কত আত্মীয়–অনাত্মীয়ের বিয়ের সাজে সেজেছে এই বাড়ি। কখনোবা পঞ্চায়েতের সভা। কেউ শহরে এসেছেন চাকরির পরীক্ষা দিতে, কেউ চিকিৎসা করাতে, কেউবা হোস্টেল না পেয়ে অস্থায়ী আশ্রয়—অপরাজিতা হয়ে ওঠে সবার জন্য উন্মুক্ত এক ঠিকানা।

দুই মেয়ে যে একাডেমিতে নাচ আর আঁকা শিখত, একসময় সেই একাডেমিও পরিচালনা শুরু হলো এই বাড়ি থেকে। ছুটির দিন সকালে সেখানে হারমোনিয়ামের সুর উঠত, অন্যদিকে রংপেনসিলে আঁকিবুঁকি। বিকেলে চলত ঘুঙুরের ঝংকার আর সন্ধ্যা নামলে ইংরেজির শিক্ষক সাখাওয়াৎ হোসেনের ব্যাচ পড়ানো। সব মিলিয়ে বাড়িটা যেন এক শিক্ষা–সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

কিন্তু সময় বদলায়। আশপাশের খালি জমিগুলোতে একের পর এক উঁচু ভবন উঠে যেতে শুরু করে। পাশের জমিতে পাইলিংয়ের মেশিনের ধকধক শব্দে কেঁপে ওঠে অপরাজিতার মাটি। তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এবার সময় এসেছে নতুন করে ভাবার। পুরোনো টিনের ঘর ভেঙে পাঁচতলা একটি ভবন গড়া হবে।

দুই কাঠা জমিতে পাঁচতলার এক ভবন

পুরোনো স্মৃতি, নতুন কাঠামো

নতুন বাড়ির নকশার ভার এসে পড়ে বাড়ির বড় মেয়ে, অর্থাৎ আমার কাঁধে। আমি তখন স্থাপত্যের শিক্ষার্থী। সবে তৃতীয় বর্ষ শেষ করেছি। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রজ দুই স্থপতিকে মূল দায়িত্ব দেওয়ার জন্য মা-বাবাকে রাজি করাই। সামিন রহমান ও নিশাত তাসনিমের স্থাপত্যচর্চার ফার্ম নীন আর্কিটেক্টস। তাঁদের সঙ্গেই শুরু হলো নকশা নিয়ে নানা আলোচনা।

এই শহরেও মাটির কাছাকাছি থেকে বড় হয়ে উঠেছে আমাদের বাড়ির মানুষেরা। সেই সবুজ, সেই বৃষ্টির শব্দ, সেই টলটলে শিশির—এসবই ছিল বড় হয়ে ওঠার অংশ। তাই পাঁচতলা ভবনের নকশা ভাবতে গিয়ে শুধু ইট-কাঠ-সিমেন্ট নয়, মাথায় ঘুরছিল কীভাবে এই নতুন গড়নে পুরোনো চেনা অনুভবগুলোও রাখা যায়! যার গায়ে লেগে থাকবে পুরোনো অপরাজিতার স্মৃতি। তবে বাস্তবতার হিসাবটাও ছিল। মা–বাবার শেষজীবনের সঞ্চয়ে গড়া এই বাড়ির একাংশ ভাড়া দিয়ে পরিবারে একটু আর্থিক স্বস্তিও যেন এনে দিতে পারে।

এসব ভাবনা মাথায় রেখেই নকশা করা শুরু হয়। নিচতলায় রাখা হলো গ্যারেজ, কেয়ারটেকারের থাকার জায়গা আর সিঁড়ি, লিফট ও লবির মতো প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো।

একতলা, দোতলা আর তিনতলায় ভাড়া দেওয়ার জন্য তিনটি ফ্ল্যাট। প্রতি ফ্ল্যাটে তিনটি শোবার ঘর, তিনটি বাথরুম, বসার ঘর, খাবারঘর, রান্নাঘর। আর আছে ২০ ফুটের টানা এক বারান্দা। যে বারান্দার দুই পাশে গাছ লাগানোর জন্য নির্ধারিত জায়গা, দুটি প্ল্যান্টার বক্স।

ওপরের দুই তলায় কাঠের সিঁড়ি দিয়ে করা হয়েছে ডুপ্লেক্স

আমাদের ডুপ্লেক্স

চারতলা, পাঁচতলা আর ছাদ মিলিয়ে আমাদের থাকার জায়গা। দুই কাঠার ছোট্ট জমিতে নিজেদের ডুপ্লেক্স গড়তে গিয়ে আলাদা সিঁড়ি রাখার জায়গা পাওয়া ছিল চ্যালেঞ্জের মতো। শেষে ঠিক করা হলো—নিচ থেকে ওঠা সাধারণ সিঁড়িটা চারতলায় এসে থেমে যাবে। ডুপ্লেক্সের ভেতর দিয়ে সেই সিঁড়িই বর্ধিত অংশসহ উঠে যাবে পাঁচতলা হয়ে ছাদ পর্যন্ত।

আগেই বলেছি, অতিথিবৎসল পরিবার আমাদের। তাই বসার জায়গা, খাওয়ার জায়গা যেন খোলামেলা হয়, সেই চিন্তা মাথায় রেখে ডুপ্লেক্সের নিচতলায় রাখা হলো প্রায় ২০ ফুট বাই ২৫ ফুটের একটি বড় বসার ঘর ও খাবারের জায়গা। এর এক পাশজুড়ে ২০ ফুট লম্বা বারান্দা, সঙ্গে ভাঁজ করা দরজা। সেই দরজা খুলে রাখলেই ঘর–বাহির মিলেমিশে একাকার।

শয়নকক্ষ

রান্নাঘর, গল্প আর জানলার ভাঁজ

অন্য পাশে রান্নাঘর, মা-বাবার শোবার ঘর আর একটি সাধারণ বাথরুম। রান্নাঘরের নকশাতেও মাথায় রাখা হয়েছে এই ভোজনরসিক পরিবারের চিফ শেফ, আমার মায়ের কথা। চারকোনা রান্নাঘরে ইংরেজি ইউ শেপে করা হয়েছে কিচেন ক্যাবিনেট। খাবার টেবিলের পাশে রান্নাঘরের যে কিচেন টপ, তার ওপর আছে ভাঁজ করা জানালা। এই জানালা চাপিয়ে দিলেই রান্নাঘরে কাজ করতে করতে গল্প করা যায় বসার ঘর আর খাবার ঘরের লোকজনের সঙ্গে। এ যেন বসার ঘর, খাবার ঘরের সঙ্গে রান্নাঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ‘গল্প–জানালা’।

প্রচলিত নকশায় রান্নাঘর প্রায়ই আলাদা করে ফেলা হয়। ঘরের মূল জীবন থেকে দূরে সরে যায় রান্নাঘর। তা যেন কোনোভাবেই না হয়, সেটা মাথায় রাখা হয়েছিল। আবার অতিথি এলে বা ধরুন মরিচ পোড়ানোর সময়ও এই জানালা লাগিয়ে ঝাঁজ সরাতে কিচেন হুড আর এগজস্ট ফ্যান আছে।

ঘরের মাঝে খোলা আকাশ

বসার ঘর থেকে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ির প্রথম ধাপটা একটা বড় প্ল্যাটফর্মের মতো। ওখানে বসেই বারান্দা দিয়ে চাঁদ যেমন দেখা যায়, টিভিতে ফুটবল ম্যাচ দেখার সময় প্যাভিলিয়নও বানিয়ে নেওয়া যায় পুরো সিঁড়িটাকে।

ডুপ্লেক্সের এই সিঁড়ির ওপর ডাবল হাইট বা দুই গুণ উচ্চতায় ছাদ। সেই ছাদ অবশ্য কংক্রিটের বদলে করা হয়েছে টেম্পারড গ্লাস দিয়ে। যে কাচ দিয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে আসা যায় সূর্যের আলো আর পূর্ণিমার চাঁদ। টেম্পারড গ্লাস হওয়ায় এর ওপর দিয়ে হাঁটাচলাতেও সমস্যা নেই। শিশু থেকে প্রবীণ—ছাদে গিয়ে এই কাচের ওপর হাঁটা যেন সবার জন্যই অন্য রকম রোমাঞ্চ।

ছবি: কবির হোসেন

বদলানো নকশায় স্থাপত্যের ব্যাকরণ

বাড়ি বানানোর এই প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনে বা সবার মতামতেই অনেক জায়গায় নকশার বদল হয়েছে। স্থাপত্যের ব্যাকরণ আর মা-বাবার আবেগ—দুটিকেই প্রাধান্য দিয়ে নিজেকেই এই নকশা বদলের দায়িত্ব নিতে হয়েছে বারবার।

সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেই প্রথমে একটি পারিবারিক বসার ঘর। সেখান থেকে তিন দিকে ছড়িয়ে আমাদের তিন ভাই–বোনের শোবার ঘর। একদিকে ছাদে ওঠার সিঁড়ি, পাশেই বাড়ির লিফট, অন্যদিকে আধা ছাদখোলা একটি প্রশস্ত টেরাস।

এই ফ্লোরে লিফট কোনো লবি ছাড়াই সরাসরি পারিবারিক বসার ঘরের ভেতর এসে খোলে। তবে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা নেই। এই তলায় শুধু সেই সদস্যরাই লিফট কল করতে পারেন, যাঁদের আঙুলের ছাপ আগে থেকে সংরক্ষিত রয়েছে লিফটের স্বয়ংক্রিয় মেশিনে।

এই তলায় একটি শোবার ঘরের সঙ্গে রয়েছে ছাদখোলা বারান্দা ও প্ল্যান্টার বক্স। সূর্য মামা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই আলো আর বাতাসকে সঙ্গে করে এ ঘরে ঢুকে পড়ে। এ ঘর থেকে একটা জানালা আছে ডুপ্লেক্সের সিঁড়ির ওপর। তাই এ ঘর থেকে চাইলেই খোঁজ রাখা যায় নিচের তলায় কে এল, কে গেল!

নকশা বদলের কারণে অন্য একটি ঘরের ভেতরে কলাম এসে পড়েছিল। যেটিকে ঢাকা হয়েছে অন্দরসজ্জার কৌশলে। আর তৃতীয় শোবার ঘরটি লাগোয়া সেই খোলা টেরাস, যা বাড়ির সবচেয়ে প্রাণবন্ত কোণগুলোর একটি। দক্ষিণমুখী এই টেরাসে সারা দিন বাতাস খেলা করে। এখানে বসে গান হয়, গল্প জমে। গাছের পাতার নড়াচড়ায় ছায়া নামে আর পাশে রাখা দোলনায় বসে কাটে পড়ন্ত বিকেল।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লেখক (বাঁয়ে দাঁড়ানো)

ছাদখোলা ছাদের সিঁড়ি

বাড়ির ছাদে ওঠার জন্য যে সিঁড়িটা, সেটিও যেন একটা ছোট আড্ডার জায়গা। ছাদখোলা এই সিঁড়িতে তেমন নির্দিষ্ট কিছু না থাকলেও এখানে বসেই জমে ওঠে গল্প। সকালের আলো গায়ে মাখতে কিংবা বিকেলে দক্ষিণের হাওয়া খেতে বা ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে চাইলে এই সিঁড়িও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

ঘর আর ছাদের মাঝামাঝি এই কোণ অনেকটা যাত্রাবিরতির মতো—না পুরো ঘরের ভেতর, না পুরো বাইরের। কিন্তু ঠিক এই জায়গাতেই তৈরি হয় অনেক স্মৃতি—আনমনা দুপুর, অলস বিকেল অথবা বন্ধুদের গল্পে, হইহুল্লোড়ে কাটানো সন্ধ্যা।

ছাদের হাওয়া, উঠানের চেনা গন্ধ

ধীরে ধীরে ছাদে গড়ে উঠছে অপরাজিতার পুরোনো সেই উঠান। মা যেমন করে একসময় টিনের বাড়িতে, আঙিনাজুড়ে সবজি, ফুল, ফলের গাছ লাগাতেন, সেই আয়োজনই এবার শুরু হয়েছে ছাদে। টবে টবে লাউ, টমেটো, পুঁইশাক, আম, পেঁপে আর বেলি ফুল। আরেক দিকে দেশি মুরগি আর কবুতরের খাঁচা। ছোটখাটো খামারের মতোই যত্নে বেড়ে উঠছে সেসব।

ছাদের আরেক পাশে রাখা হয়েছে ছোট একটা লিফট লবি। যেহেতু বাড়ির মূল সিঁড়ি ডুপ্লেক্সের ভেতর হয়ে ঘুরে আসে, তাই লিফটটা ছাদ পর্যন্তই এনে থামানো হয়েছে। ছাদের বাড়ি অংশে কখনো আড্ডা, কখনো বারবিকিউ তো কখনো হয় ঝোলাভাতি!

মাটি থেকে অনেকটা ওপরে উঠে এসেও মাটি, রোদ, বৃষ্টি, দখিনা বাতাস নিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের নতুন অপরাজিতা। আত্মীয় আর বন্ধুমহলের সেই প্রিয় আড্ডা দেওয়ার জায়গা, ভিন্ন ভিন্ন পরিসর নিয়ে পুরোনো অপরাজিতা যেন জেগেছে নতুন রূপে, নতুন ভালোবাসায়।