দেখুন নাশিদ কামালের বাড়ির ইন্টেরিয়র, এ যেন দুর্লভ জিনিসের সংগ্রহশালা

মা নাশিদ কামাল–মেয়ে আরমীন মুসা দুজনই গানের অনুরাগী
ছবি: কবির হোসেন

কলিং বেলের শব্দ শুনেই গৃহকর্মী এসে দরজা খুলে দিলেন। বাড়ির বাসিন্দাদের আগে থেকেই জানান দেওয়া ছিল, আমরা আসছি। বাড়ির সদস্যদের একজন তখন নিজের ঘরে আছেন, আরেকজন যুক্ত হবেন খানিক পরে।

দরজা খোলার পর প্রথম নজর কেড়ে নিল পুরোনো দিনের একটি গ্রামোফোন। সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় পেয়েছেন এই বাসার এক সদস্য, যিনি নিজেও গান গাইতে ভালোবাসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উপস্থিত হলেন তিনি। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া এই গ্রামোফোনের গল্প বলতে বলতে কিছুটা যেন নস্টালজিক হয়ে পড়েন।

‘আমার বড় বাবা আব্বাসউদ্দীনের এই গ্রামোফোনটি তাঁর ছেলে মোস্তাফা কামালের কাছে ছিল। মোস্তাফা কামাল আমার নানাভাই। তাঁর কাছ থেকেই এটি আমি উপহার পাই। এটি আমার কাছে এক অমূল্য সম্পদ।’ কথাগুলো বলছিলেন এই সময়ের সংগীত তারকা আরমীন মুসা। বিশিষ্ট নজরুলসংগীতশিল্পী অধ্যাপক ডা. নাশিদ কামালের মেয়ে আরমীন। বর্ণিল বসত–এর পক্ষ থেকে এই তারকা মা–মেয়ের বাড়িতে আমরা এবার হাজির হয়েছিলাম। তাঁদের স্মৃতিচারণায় গানের গল্প নয়, আমরা এবার শুনলাম ঘর সাজানোর গল্প।

এই বাসায়ই ‘ঘাসফড়িং’য়ের রিহার্সাল হয়

পুরানা পল্টনে আব্বাসউদ্দীনের যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন নাশিদ কামাল। তখন সব সময়ই লোকজনের আনাগোনা থাকত হীরামন মঞ্জিলে (দাদার বাড়িতে)। চলত সংস্কৃতিচর্চা।

গুলশানে নিজের এই ফ্ল্যাটে সেই আবহ ধরে রাখার চেষ্টা করেন নাশিদ কামাল। মেয়ের বন্ধুদের সংগীতচর্চাও চলে এই বাড়িতে। ‘আমাদের ঘাসফড়িংয়ের রিহার্সাল এই বাসা থেকেই শুরু হয়,’ জানালেন আরমীন।

আরমীন মুসা গ্রামোফোনটি সংগীতশিল্পী আব্বাসউদ্দীনের কাছ থেকে বংশপরম্পরায় পেয়েছেন

গান ও কাজ—এই দুই সূত্রেই ছাত্রজীবন থেকে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন নাশিদ কামাল। ভ্রমণ করেছেন নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, জাপান, ফিনল্যান্ড, কেনিয়াসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে।

যখন যে দেশে যেতেন, চেষ্টা করতেন সেখানকার সংস্কৃতি ধারণ করে—এমন জিনিস সংগ্রহ করার। তাই নাশিদ কামালের বাসাজুড়েই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন দেশের সেসব দুর্লভ সংগ্রহ। আলোকচিত্রী ছবি তুলছিলেন আর ফাঁকে ফাঁকে বাসা ঘুরে দেখাতে দেখাতে সেসব গল্প বলছিলেন নাশিদ কামাল।

খাবার টেবিলের সঙ্গে মিল রেখে বাসার অন্য আসবাবগুলোর নকশা করা হয়

২০০৪ সালে এই ফ্ল্যাটে ওঠেন তাঁরা। ধীরে ধীরে শুরু হয় বাসা সাজানোর কাজ। নাশিদ কামাল বলেন, শুরুতে খাট, ছোট ডিভান আর গোল একটা খাবার টেবিল ছিল। বেশ সময় নিয়ে বাসার অন্যান্য জিনিস করেছি।

নেপালে ঘুরতে গিয়ে সেখানকার আসবাবের প্রতি নাশিদ কামালের বিশেষ আগ্রহ জন্মায়। বিশেষ করে সেখানকার খাবার টেবিলগুলোর নকশা দেখে তাঁর মনে হতো, এমন একটা টেবিল যদি ঢাকায় তাঁর বাসার খাবারঘরেও থাকত!

যখন যে দেশে গিয়েছেন, সেখানকার সংস্কৃতি ধারণ করে—এমন জিনিস সংগ্রহ করেছেন নাশিদ কামাল

‘আমার এক বন্ধু আছে, নাম সাবিনা পান্নি। সে করটিয়ার জমিদারবাড়ির বউ। একবার নেপালে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা হয়। সৌভাগ্যবশত জানতে পারি, সে আসবাব নিয়ে কাজ করে। নেপালের আসবাবের নকশা দেখে ঢাকায় এসে তার নিজস্ব কাঠমিস্ত্রি দিয়ে তৈরি করেন এসব আসবাব।

যখন তাকে আমার ইচ্ছার কথা জানালাম, বলল যে তুমি এর পরেরবার ছবি তুলে এনো।’ নাশিদ কামালের তুলে আনা ছবি দেখে সাবিনা পান্নি এই বাসার খাবার টেবিলটি বানিয়ে দিয়েছিলেন। লেকার পলিশের খাবার টেবিলটিতে টেবিল টপ হিসেবে গ্লাসের ব্যবহার করা হয়েছে। টেবিলের পায়াগুলো আসবাবটির মূল আকর্ষণ। সেখানে আছে হাতির নকশা।

সিলিংয়ের ঝাড়বাতিটি যেন পুরোনো দিনের জমিদারবাড়ির আবহ তুলে ধরেছে ঘরটিতে। এই বাসায় খাবার টেবিলের একটি দেয়ালজুড়ে আছে মিড হাইটের ক্যাবিনেট, যেখানে রাখা আছে বিভিন্ন দেশের শোপিসের সংগ্রহ।

সংগ্রহের আরও কিছু

খাবার টেবিলের সঙ্গে মিল রেখে সাবিনা পান্নি বাসার অন্য আসবাবগুলোর নকশা করেন। সদর দরজার পাশেই বাঁ দিকের দেয়ালে সাঁটানো আছে আয়না। নিচে আছে কাঠের ক্যাবিনেট, যেটি সরাসরি নেপাল থেকে আনা। তার সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হয়েছে আয়নাটি। তবে বাসার বসার ঘরের সোফাগুলো তৈরির সময় সাবিনা করটিয়া জমিদারবাড়ির আসবাবের নকশা সংযুক্ত করেন।

সংগীতচর্চার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি ও পড়াশোনার জন্য নাশিদ কামালের একটি নিজস্ব ঘর আছে। এ ঘরেই দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে তাঁর। ঘরটির নকশা করেন আমবারিন নামের এক অন্দরসজ্জাবিদ। আরমীন মুসা বলছিলেন, ‘আমাদের পরিবারের প্রায় প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতেই এমন বুক ক্যাবিনেট আছে, যা এই পরিবারের ঐতিহ্যই বলা যায়।’ জানা গেল, এই লাইব্রেরিতে আরমীন মুসার মায়ের দাদাসহ তাঁদের পরিবারের প্রত্যেকের লেখা বই আছে।

পুরোনো স্মৃতি আঁকড়েই এই বাসার মানুষেরা বাঁচতে ভালোবাসেন

পুরোনো অনেক স্মৃতি আঁকড়েই যে এই বাসার মানুষেরা বাঁচতে ভালোবাসেন, বাড়ির টেলিভিশনটি সে কথা আরেকবার মনে করিয়ে দেয়। আরমীন বলেন, ‘টিভিতে আমাদের কারও অনুষ্ঠান হলে এখান থেকে মা সেটা ভিসিআরে রেকর্ড করে রাখেন।’

কথায়–কথায় জানা গেল, বছর দুয়েক ধরে কাছাকাছি এলাকায় নিজে আলাদা বাসা নিয়েছেন আরমীন। তবে প্রতিদিনই একবার মায়ের সঙ্গে এই বাসায় সাক্ষাৎ হয় তাঁর।

মা–মেয়ে দুজনই গানের অনুরাগী। মেয়ে তাই মাকে বানিয়ে দিয়েছিলেন সুরমণ্ডল (বিশেষ যন্ত্র)। ‘মায়ের আরেকটি সুরমণ্ডল আছে, যেটা তাঁর ফুফু (ফেরদৌসী রহমান) তাঁকে দিয়েছেন,’ বলছিলেন আরমীন মুসা।

সেই দুই সুরমণ্ডল বাজাতে বাজাতে মা–মেয়ে ডুবে গেলেন গানের জগতে। সিলিংজুড়ে থাকা ঝাড়বাতির আলো–আঁধারি আলোকসজ্জা ও সুরের মোহনীয়তা মুহূর্তেই যেন বাসার পরিবেশকে দিল এক মায়াবী রূপ।