বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আল মোমেন
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আল মোমেন

খামারের তাপ নিয়ন্ত্রণ করবে এআই, বাকৃবির শিক্ষার্থীর গবেষণা

রোদ উঠে গেছে অনেকক্ষণ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গোট, শিপ ও হর্স রিসার্চ ফার্মের কর্মচারী আবদুল করিম ছায়ায় দাঁড়িয়ে বললেন, ‘গরমে আমি যেমন হাঁসফাঁস করছি, খামারের পশুগুলোও নিশ্চয় কষ্টে আছে। গরুগুলো খাচ্ছে কম। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে, দুধের বালতিও হালকা হচ্ছে দিনকে দিন।’

হ্যাঁ, পশুগুলো ক্লান্ত। অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পশুর শরীরে ফেলেছে অদৃশ্য এক চাপ। এরই নাম ‘হিট স্ট্রেস’। চড়চড় করে ওপর দিকে চড়ে বসে তাপমাত্রা। সেই সঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা এতটাই বাড়ে যে মনে হয়, পশুগুলোর গায়ে ভারী কিছু চেপে বসেছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের খামারে নয়, দেশের প্রায় সব পশুখামারেই প্রতিবছর ফিরে ফিরে আসে এই দৃশ্য।

জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তনে হিট স্ট্রেস সমস্যা বর্তমানে আরও তীব্র হয়েছে। অথচ বেশির ভাগ খামারেই নেই কোনো আধুনিক ব্যবস্থা, যা আগে থেকে জানাবে ‘পশুটি ঝুঁকিতে আছে’।

ঠিক এই সমস্যারই সমাধান খুঁজছিলেন এক তরুণ গবেষক—বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আল মোমেন। তাঁর গবেষণায় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রকিবুল ইসলাম খান। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ খামারে প্রযুক্তিটি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছেন পশুবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস এম আরিফুল ইসলাম।

গবেষক দল উদ্ভাবন করেছে একটি স্বয়ংক্রিয় ‘সেন্সর-নির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) ফার্ম মনিটরিং ও হিট স্ট্রেস ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি’।

প্রযুক্তিটি কীভাবে কাজ করে বুঝিয়ে বললেন মোমেন, ‘খামারে বসানো সেন্সর নির্দিষ্ট সময় পরপর তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তথ্য সংগ্রহ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ক্লাউড প্ল্যাটফর্মে পাঠায়। এসব তথ্য পরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক একটি বিশ্লেষক মডেলে পৌঁছে যায়। বিশ্লেষক মডেলটির কাজ হলো, টিএইচআই (টেম্পারেচার-হিউমিডিটি-ইনডেক্স বা তাপমাত্রা-আর্দ্রতা সূচক) গণনা করা। টিএইচআই হলো একটি সংখ্যা, যা তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বিবেচনা করে পশুর শরীরে কেমন অনুভূত হচ্ছে, তা জানান দেয়। নিরাপদ, সতর্ক, ঝুঁকিপূর্ণ ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ—এই চার ধাপে পশুর অবস্থা বোঝায় টিএইচআই। এর ওপর ভিত্তি করে মডেলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফ্যান চালু বা বন্ধ করে। ফ্যান চালাতে খামারিকে আর সশরীর উপস্থিত থাকতে হয় না। এআই সিদ্ধান্ত নেয়, কখন ফ্যান চালু হবে আর কখন বন্ধ হবে।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় সব তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া সিদ্ধান্তগুলোর সারাংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার ব্যবস্থা রয়েছে। ওয়েবসাইটে তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়, যেন খামারি যেকোনো সময় দেখতে পারেন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন।

মোমেন জানালেন, পুরো সিস্টেমটি প্রথমবার চালু করতে খরচ হবে মাত্র আড়াই হাজার টাকা। পরে ক্লাউড ও সার্ভিসিং খরচ বাবদ বছরে খরচ প্রায় এক হাজার টাকা। একবার চালু করলে মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এটি সাত দিন পর্যন্ত চলে।

খামারি শুধু ওয়েবসাইটে পশুর অবস্থা দেখবেন আর সময়মতো পদক্ষেপ নেবেন। খামারিদের জন্য এটি হবে একটি স্বল্পব্যয়ী ও ব্যবহারবান্ধব সমাধান।

বিশ্বব্যাপী পশুর ওপর হিট স্ট্রেসের প্রভাব তুলে ধরে মোমেন বলেন, ‘হিট স্ট্রেসের কারণে আফ্রিকা ও যুক্তরাষ্ট্র অঞ্চলের বহু ডেইরি খামার দুধ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন গবেষণা জার্নালে প্রকাশিত তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে এই সমস্যার কারণে বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার।’

প্রযুক্তিটি বর্তমানে মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত। সম্প্রতি এই গবেষণা–সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধ ‘স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচারাল টেকনোলজি’ নামের একটি কিউ-১ মানের জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছে, যার ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ৫ দশমিক ৭।

প্রযুক্তিটির সম্ভাবনা নিয়ে অধ্যাপক রকিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘এই প্রযুক্তি শুধু একটি উদ্ভাবন নয়, এটি খামার ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে খামারির শ্রম কমবে, খরচ কমবে। যথাযথ ব্যবহারে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। তথ্য না–জানা, অবহেলা বা দেরির কারণে পশুর শরীরে হিট স্ট্রেসজনিত যে জটিলতা তৈরি হয়, সেগুলো এ প্রযুক্তির মাধ্যমে আগেভাগেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। প্রযুক্তিটির কার্যকর ভবিষ্যতের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’

প্রযুক্তিটি নিয়ে আরও কাজ করতে চান আল মোমেন, ‘ভবিষ্যতে এতে যুক্ত হবে অ্যামোনিয়া, মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড সেন্সর। তখন পশুর শ্বাসপ্রশ্বাস ও পরিবেশগত গুণাগুণও বিশ্লেষণ করা যাবে। ধীরে ধীরে এটি রূপ নিতে পারে সম্পূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রিসিশন লাইভস্টক ফার্মিং সিস্টেমে।’

মোমেন চান, গরমের কারণে গরুর রোগ কিংবা মৃত্যু নিয়ে খামারি যেন আর আক্ষেপ না করেন। তাঁরা আগে থেকে যেন গরুর অবস্থা জানতে পারেন আর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। সাশ্রয়ী প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে তিনি বদলে দিতে চান দেশের খামারগুলোর চিত্র।