পাঠকের কাছ থেকে কত যে মজার অভিজ্ঞতা হয়

অধুনার নিয়মিত বিভাগ ‘পাঠকের প্রশ্ন’। এই বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদ শামসুন্নাহার নাহিদ। পত্রিকায় কলাম লিখে তাঁর নানা অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে। তারই কিছু অংশ পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন তিনি।

শামসুন্নাহার নাহিদ
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিষ্ঠার পর গতকালই প্রথম আলো ২৭ বছর শেষ করল। এর মধ্যে আমি প্রায় দুই দশক ধরে পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত। মূলত অধুনা ক্রোড়পত্রে পুষ্টিবিদ হিসেবে পাঠকদের নানা প্রশ্নের সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করি। লম্বা এই সময়ে প্রথম আলোও আমাকে তাদের পরিবারের একজন করে নিয়েছে।

পাঠকদের ডায়েট–সংক্রান্ত নানা রকম প্রশ্ন আসে আমার কাছে। আমি আজকাল অবাক হয়ে খেয়াল করি, সাধারণ মানুষ পুষ্টি নিয়ে আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। দেশের উত্তরের শেষ প্রান্ত থেকে দক্ষিণের সেন্ট মার্টিন—কোন জায়গা থেকে প্রশ্ন আসে না।

অনেকে ফোন করে পরামর্শ নিতে চান। অবশ্য সব ফোন যে পরামর্শ নিতে আসে, তা–ও নয়। কেউ কেউ কড়া কথা শোনাতেও ফোন করেন। আমি সব ফোন কলই খুব আগ্রহ নিয়ে অ্যাটেন্ড করি। অধুনায় অনেক প্রশ্ন আসে, যেগুলোর আরও বিস্তারিত তথ্য না থাকলে ঠিকঠাক সমাধান দেওয়া যায় না।

তারপরও চেষ্টা করি সরলভাবে সেসব প্রশ্নের একটা উত্তর লেখার। আর সেটা প্রশ্নকারীর মনমতো না হলে ফোন করে রীতিমতো কড়া কথা শোনানোর নজিরও আছে। তবে আমি সেসব পাঠকের ফোনেও খুব মজা পাই, বোঝানোর চেষ্টা করি কেন তাঁর প্রশ্নটির প্রপার সমাধান দেওয়া যায়নি।

পাঠকেরাই প্রথম আলোর প্রাণ

প্রথম আলো বিভিন্ন সময় পাঠকদের সঙ্গে সরাসরি সমস্যা সমাধানের আয়োজন করেছে। সেটা কখনো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে, কখনো বিয়ে উৎসব বা নকশা মিলনমেলায়। সরাসরি পাঠকের মুখোমুখি হয়ে তাঁদের সমস্যার সমাধান করার সুযোগটা সত্যিই আমাকে প্রতিবার আপ্লুত করেছে।

নিজের যতই ব্যস্ততা থাকুক, আমি ওই দিনটি ফ্রি রাখার চেষ্টা করি। অধুনায় যখনই আমার লেখা বের হয়, পরিচিত–অপরিচিত পাঠকদের কাছ থেকে ফোনে, ফেসবুকে অনেক ধন্যবাদ ও প্রশংসা পেয়ে এসেছি। পাশাপাশি কিছু মজার ঘটনারও মুখোমুখি হয়েছি বিভিন্ন সময়ে। সাম্প্রতিক তেমনই কিছু অভিজ্ঞতা এখানে ভাগ করে নিই।

মাঝেমধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাঠক ওজন কমানোর পরামর্শ চান। আমি সাধারণত প্রশ্নের উত্তর এমনভাবে দিয়ে থাকি, যেন ওই সমাধান অন্য পাঠকদেরও উপকারে আসে।

এ রকম একজন পাঠক একদিন ফোন (প্রথম আলো থেকে নম্বর নিয়ে) করে আমাকে বললেন, ‘আমি আপনার কাছে ডায়েট চার্ট চেয়েছি। এত কথা লিখেছেন, চার্ট তো দিলেন না।’ এরপর তাঁকে ২০-৩০ মিনিট ধরে বোঝাতে হলো যে একজনের ব্যক্তিগত প্রপার ডায়েট চার্ট তৈরি করতে কত রকম তথ্যের দরকার হয়।

তাঁকে যেসব বিষয় বলেছিলাম, সেটা এখানেও সব পাঠকের জন্য লিখছি—

একজন ব্যক্তির বয়স, ওজন, উচ্চতা, অসুবিধা বা কোনো রোগ আছে কি না, থাকলে তার রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন দরকার হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁর খাবারের হিস্ট্রি জানা—সারা দিনে কখন, কোন খাবার, কী পরিমাণে তিনি খেয়ে থাকেন; কোনো নির্দিষ্ট খাবারে অনীহা আছে কি না, পছন্দের খাবার, খাবারে অ্যালার্জি আছে কি না, পারিবারিক বা ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী কোনো খাবার বাদ রাখেন কি না; তাঁর কাজের ধরন, সময়, অর্থনৈতিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিষয় জানতে হয়।

তাঁর শরীরের শক্তি ও পুষ্টি চাহিদা মেপে সেই অনুযায়ী ডায়েট চার্ট তৈরি করতে হয়। পাশাপাশি যদি ওজন কমানোর দরকার হয় তাহলে কাউন্সেলিং করে তাঁর লো-ক্যালরি ও স্বাস্থ্যসম্মত রান্নার পদ্ধতি, ব্যায়ামের ধরন, ঘুমের ধরন, সময়সহ একটা পরিপূর্ণ ব্যবস্থাপত্র দিতে হয়।

নইলে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। যেমন কিছুটা ওজন কমলেও দুর্বলতা, চুল পড়া, অ্যাসিডিটি, খাবারে অনীহা ইত্যাদি হতে পারে। পাশাপাশি ওজন যতটুকু কমবে তা আবার দ্রুত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

এসব বিষয় বিস্তারিত ওই পাঠককে জানিয়ে আমি প্রশ্ন রাখলাম—এবার বলেন, আপনি কি এসব তথ্য পাঠিয়েছেন? আপনার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আমি আর কতটা (যেটা লিখেছি) উত্তর দিতে পারতাম। সব শুনে এবার সেই পাঠক বললেন, ‘হ্যাঁ, এবার বুঝতে পারলাম বিষয়টা।’

চলতি বছরই আরেকজন নারী পাঠক একদিন ফোন করে রীতিমতো কিছুক্ষণ ঝাড়ির ওপরে রাখলেন আমাকে। তাঁর মনে যত রাগ ছিল সবই উগরে দিলেন। এই পাঠক চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাঁর বিয়ের এক মাস আগে। বিয়ের অনুষ্ঠানের আগে তিনি ১৫ কেজি ওজন কমাতে কী করবেন জানতে চেয়েছিলেন। আমি তখন তাঁকেও ওপরে উল্লেখ করা বিষয়গুলো বোঝালাম।

এরপর সেই পাঠক পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘পুষ্টিবিদ হয়ে তাহলে আপনি কী করতে পারেন? আমি ভাত-রুটি সবই বাদ দিয়েছি, দিনে মাত্র দুইবার (দুপুর ও রাত) খাই, তারপরও ওজন কমছে না। আপনি তো আমাকে কোনো সাহায্যই করলেন না। আমার বিয়ের ছবিতে তো আমাকে মোটা দেখাবে।’ এবার জানতে চাইলাম, আপনি রাতে ঘুমান কখন? সকালের নাশতা কেন বাদ দিয়েছেন?

তিনি বললেন, ‘রাতে আমার ঘুম হয় না। রাত তিনটা-চারটার দিকে ঘুমাই। উঠি বেলা একটার দিকে। তাই একবারে দুপুরে খাই, যাতে ওজন কমে।’

আপনি কি কোনো ব্যায়াম করেন? এবার বললেন, ‘না না, রোদে গেলে আমার গায়ের রং কালো হয়ে যাবে। বিয়ের আগে ব্যায়াম করতে পারব না।’ আরও নানা কথা হলো, সবটা এখানে নাই–বা লিখলাম। এরপর তাঁকে বোঝালাম, তাঁর কেন ওজন কমছে না।

বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আয়োজন উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্তে যেতে হয় আমাকে। সেসব জায়গায় হঠাৎ যখন কেউ এসে বলেন, প্রথম আলোতে আপনার কলাম পড়ি, আপনাকে চিনি—তখন খুব ভালো লাগে।

যাহোক, পাঠকদের পুষ্টি বিষয়ে সচেতন করতে প্রথম আলোর সঙ্গে আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।