সারি সারি আমগাছের মাথায় এসে পড়েছে শীতের নরম রোদ। বিশাল মাঠের সবুজ ঘাসগুলোতে হলদেটে ভাব। মাঠেই শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট জটলা। চলছে হাসাহাসি, কথা, গল্প আর খুনসুটি। এককোনায় কেক কেটে বন্ধুর জন্মদিন উদ্যাপন করছে একটা দল।
৭ জানুয়ারি দুপুরে খুলনার সরকারি ব্রজলাল কলেজমাঠের কয়েকটি খণ্ডচিত্র। মাঠের পাশ দিয়ে শহীদ মিনারের পাশের বকুল চত্বরের দিকে চলে যাই আমরা। এদিকটায় কলেজের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মীদের আড্ডা আর অনুশীলনকেন্দ্র। একটি কক্ষে আবৃত্তি দলের কর্মীরা উচ্চারণ অনুশীলন করছেন। পাশের কক্ষে যুক্তি আর পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে চলছে বিতর্কের মহড়া। অংশ নিয়েছেন ডিবেটিং ক্লাবের সদস্যরা। ২০১২ সালে তৈরি হওয়া এই ডিবেটিং ক্লাব শিক্ষার্থীদের বিতর্কচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রবি, মঙ্গল আর বৃহস্পতি—সপ্তাহে তিন দিন হয় বিতর্ক অনুশীলন। সোমবার পাঠচক্র।
ডিবেটিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইংরেজি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইলমী জানালেন, ডিবেটিং ক্লাবের সদস্যসংখ্যা এখন ১০০ জনের ওপর। জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ভালো করার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা আয়োজনের অভিজ্ঞতাও তাঁদের আছে। চলতি বছর একটি জাতীয় ও একটি আঞ্চলিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা।
বিএল ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এই কলেজের অনেক অবদান। পদ্মার এপারে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। সেই অভাব বিএল কলেজ পূরণ করেছে। বিশেষ করে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের উচ্চশিক্ষার জন্য এর কোনো বিকল্প ছিল না।উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক এফ এম আবদুর রাজ্জাক
মহড়া শেষে বিতর্ক দলের কয়েকজন গেলেন মাঠের দিকে। আমরাও প্রশাসনিক ভবনের সামনের দিক দিয়ে এগোতে থাকি। যোগ দিই শিক্ষার্থীদের এক আড্ডায়। দলটির সবাই ভূগোল বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তাঁদের একজন দেবজ্যোতি হালদার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে বিএল কলেজের অনেক নামডাক শুনেছি। আট মাস হলো ভর্তি হয়েছি। ডুমুরিয়ার শাহপুরের দিকে আমার বাড়ি। কলেজ বাসে করেই যাওয়া–আসা করি। কলেজে পড়ালেখার পরিবেশ খুব ভালো। এরই মধ্যে রাখাইনদের জীবন-জীবিকা নিয়ে একটা জরিপের জন্য আমরা ৫৫ জনের একটা দল কুয়াকাটা ঘুরে এসেছি।’
আড্ডা দলের নারী সদস্য লামিয়া ইসলামও কলেজ নিয়ে ব্যাপক খুশি, ‘আশপাশের কোনো কলেজে ভূগোল বিষয় নেই। আমাদের রেগুলার ক্লাস হয়। ৬৫ শতাংশ ক্লাস না করলে পরীক্ষা দিতে দওয়া হয় না। ক্লাসের অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডাও হয়। আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবার সঙ্গে সবার বন্ডিং ভালো। কোনো র্যাগিং নেই। স্যারদের সঙ্গেও কমিউনিকেশনটা ভালো।’
খুলনার প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান
বৃহত্তর খুলনায় উচ্চশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান সরকারি ব্রজলাল কলেজ। এখনো এ অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে ও মননে জ্ঞানের আলো জ্বেলে চলেছে। বিএল কলেজ নামেই বেশি পরিচিত ৪১ একরের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী এখন ৩৩ হাজার। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক পাস, ২১টি বিষয়ে স্নাতক সম্মান এবং ২০টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য সাতটি হোস্টেল রয়েছে।
ক্যাম্পাসে প্রায় প্রতিদিনই আসেন অর্থনীতি চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমান। এই শিক্ষার্থীর কাছে ক্যাম্পাসের সুবিশাল মাঠ, গোছানো পরিবেশ, পড়ালেখার মান, সহপাঠীদের সহমর্মিতা, শিক্ষকদের আন্তরিকতা—সবই ভালো লাগে। কলেজে ঢুকলেই নাকি তাঁর মধ্যে একটা অন্য রকম ভালো লাগা আর প্রশান্তি কাজ করে।
শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ২০১৯ সাল থেকে তাঁরা বিএল কলেজ জার্নাল নামে জার্নাল প্রকাশ করছেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষার এই জার্নালে ভাষা ও সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, পরিবেশবিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও কলেজের শিক্ষক-গবেষকেরা লিখছেন। এখন পর্যন্ত জার্নালের ১১টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার ভালো পরিবেশ এখানে রয়েছে। সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় বিএল কলেজ থিয়েটার, ডিবেটিং ক্লাব, আবৃত্তি সংগঠন ‘বায়ান্ন’সহ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ভূমিকা রাখে। এর বাইরেও জীবনমুখী শিক্ষার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ক্লাব। আমাদের কলেজ গ্রন্থাগারে বই আছে ৫০ হাজারের ওপর।
শত বছরের ইতিহাস
দুটি টিনশেড ঘর নিয়ে ১৯০২ সালের ২৭ জুলাই ‘হিন্দু একাডেমি’ নামে প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তন করেন শিক্ষানুরাগী ব্রজলাল চক্রবর্তী। প্রথম দিকে সম্পূর্ণ আবাসিক প্রতিষ্ঠানটি ‘চতুষ্পাঠী’ এবং ‘একাডেমি’ নামে দুটি শাখায় বিভক্ত ছিল। চতুষ্পাঠীর ছাত্রদের খাবার, পড়া ও আবাসন খরচ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বহন করা হতো। ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠানটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯১২ সালে খুলনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসীনের সৈয়দপুর এস্টেট থেকে ৪০ একর জমি কলেজকে দান করা হয়। ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠাতা ব্রজলালের মৃত্যুর পরে কলেজের নাম করা হয় ব্রজলাল হিন্দু একাডেমি। একাডেমিকে পরে কলেজে উন্নীত করা হয় এবং সংক্ষিপ্ত করে নাম রাখা হয় বিএল কলেজ। ১৯৬৭ সালের ১ জুলাই এটি সরকারি কলেজে পরিণত হয়।
গবেষক ও ব্রজলাল কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক শংকরকুমার মল্লিক বলেন, আবাসিক কলেজ হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং এটি ছিল অবিভক্ত বাংলার প্রথম আবাসিক কলেজ।
শংকরকুমার মল্লিক জানান, ইতিহাস–গবেষক অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্র, ছন্দগুরু প্রবোধচন্দ্র সেন, অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত, অমূল্যধন সিংহ, ড. নীলরতন সেন, মুনীর চৌধুরী, সুবোধচন্দ্র মজুমদার, জিল্লুর রহমান, মো. আবদুল গণি, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ কৃতী শিক্ষক এই কলেজে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা করেছেন। এই কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীমউদ্দীন, ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান প্রমুখের আগমন ঘটে।
কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক এফ এম আবদুর রাজ্জাক বলেন, বিএল ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে এই কলেজের অনেক অবদান। পদ্মার এপারে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। সেই অভাব বিএল কলেজ পূরণ করেছে। বিশেষ করে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের উচ্চশিক্ষার জন্য এর কোনো বিকল্প ছিল না। এখানকার শিক্ষার পরিবেশ অনেক সুন্দর। শিক্ষার্থীরা অনেক সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করেন। শিক্ষকেরাও খুব আন্তরিক।