
দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা অনেকেই নতুন করে আবার সুন্দরবনের ডাকাত দলে নাম লিখিয়েছেন। ডাক পেয়েও কেন গেলেন না সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ এলাকার আলম সরদার, সেই গল্প শুনেছেন ইমতিয়াজ উদ্দীন
মুন্সিগঞ্জ বাজারে আলম সরদারের সঙ্গে দেখা। ফরসা চেহারা, মুখে দাড়ি, পরনে পোলো শার্ট আর ট্রাউজার। ইজিবাইকের চালকের আসনে বসা মানুষটাকে দেখে কে বলবে, একসময় দস্যুতা করতেন। পাশের চুনা নদীর ওপারে সুন্দরবন, যেখানে জীবনের অন্ধকার একটা অধ্যায় কেটেছে। সেই জীবন ছেড়ে এখন তিনি সংসার চালাচ্ছেন এই ইজিবাইক চালিয়ে।
৪৪ বছর বয়সের আলম সরদার বললেন, ‘পরিচিত অনেক আত্মসমর্পণকারীই আবার দস্যুতায় ফিরে গেছে। বারবার ফোন করে আমাকে দলে টানতে চায় তারা। কিন্তু আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, ওই পথে আর ফিরব না। এই ইজিবাইক চালিয়েই এখন তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে ভালোভাবে সংসার চলছে, এতেই শান্তি।’
তারপর অতীতে ডুব দিলেন আলম সরদার। বলতে থাকলেন, ‘জীবনের শুরুটাই দুঃখকষ্টে ভরা। জন্মের তিন মাস পর মা-বাবা আলাদা হয়ে গেল। বড় হয়েছি নানির কাছে। ছোট থেকেই মামার সঙ্গে সুন্দরবনে যেতাম। মাছ আর কাঁকড়া শিকার করতাম। লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। ১৭ বছর বয়সে মামা মারা গেল। তখন নানির অনুরোধে বিয়েও করতে হলো। দুবেলা খাওয়ার জোগাড় করাও কষ্টের ছিল।’
সেই সময় এলাকার যাঁরা ডাকাতি করতেন, তাঁরা আলমকে লোভ দেখাতেন। বলত, ‘চল, অনেক টাকা হবে।’
অভাব ঘোচাতে ২০০৮ সালে ডাকাত দলে যোগ দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য বুঝলেন, এই কাজ তাঁর না। এলাকায় পরিচিত জেলেদের জিম্মি করে টাকা আদায় করতে হয়। এই কাজ করতে খুব কষ্ট লাগে। বনের মধ্যে সব সময় মৃত্যুঝুঁকি, এক ঘণ্টাও শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। তত দিনে নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে ‘ডাকাত’। বাড়ি ফেরার পথও বন্ধ। মাস ছয়েক পর সুন্দরবন ছেড়ে যশোরের বেনাপোলে চলে গেলেন। বাসা ভাড়া নিলেন। তুলা কেনাবেচার কাজ নিলেন। সিম পাল্টে ফেলে নতুনভাবে জীবনটা শুরু করতে চাইলেন।
সবকিছু ভালোই চলছিল। হঠাৎ খুলনার এক অস্ত্র কারবারির ফোন। আলম বলেন, ‘গালকাটা মাসুদ ফোন দিয়ে আবার সুন্দরবনে ফিরতে চাপ দিল। কিন্তু রাজি হলাম না। সেদিনই র্যাব আমাকে ধরে ফেলল। অস্ত্রের খোঁজ জানতে চাইল। পরে মামলা দিয়ে জেলে পাঠাল। ১১ মাস জেল খেটে বের হলাম অসুস্থ শরীরে। পেটে অপারেশনও করতে হলো, ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারতাম না।’
এরই মধ্যে খবর এল সুন্দরবনে আলিফ বাহিনী আর মোক্তারুল বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে পড়ে এক জেলে মারা গেছেন। সেই হত্যা মামলায় আলম সরদারের নামও আসামির তালিকায় ঢুকে গেল। তিনি বলেন, ‘অথচ আমি তখন লোকালয়ে অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলাম! উপায়ান্তর না দেখে আবারও সুন্দরবনে পালাতে হলো।’
আলম সরদারের নামে জারি হলো হুলিয়া। কয়েক বছর ডাকাত দল চালানোর পর ২০১৫ সালে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। সে দেশে থাকতেই খবর পান বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিচ্ছে সরকার। সুন্দরবনের কুখ্যাত মাস্টার বাহিনী সে সময় আত্মসমর্পণ করে। আলমের মনেও জন্ম নিল স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ইচ্ছা। আবারও সুন্দরবনে এসে তাঁর সঙ্গে যাঁরা দস্যুতায় নাম লিখিয়েছিলেন, তাঁদের আত্মসমর্পণে উৎসাহ দিলেন। ২০১৬ সালের ৮ মে তাঁরা ১৪ জন ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার আটটি বিভিন্ন ধরনের গুলি জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। পুনর্বাসনের জন্য সরকারের দেওয়া এক লাখ টাকায় কেনেন পুরোনো ইজিবাইক। সেই দিন থেকে শুরু তাঁর নতুন জীবন।
এখন মুন্সিগঞ্জ থেকে নওয়াবেঁকী, কখনো বুড়িগোয়ালিনী কিংবা শ্যামনগর পর্যন্ত ইজিবাইক চালিয়ে যা আয় হয়, তাই দিয়ে চলে সংসার। সম্প্রতি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন। আলম সরদারের চোখেমুখে প্রশান্তির ছাপ। বললেন, ‘অতীতের ভুল জীবনে আর ফিরতে চাই না। এই ইজিবাইকেই আমার সংসারের ভরসা, এই পথেই আমার শান্তি।’