‘এখন আর ব্লাড লাগবে না। আপনারা শুধু নাম নিবন্ধন করে চলে যান।’ হ্যান্ডমাইকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের (বিএনসিসি) এক সদস্য এই কথাই শুধু বলে যাচ্ছেন। বিকেল পাঁচটার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বাইরে তখনো কয়েক হাজার মানুষের ভিড়।
কেউ এসেছেন ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে, কেউ আবার ঢাকার বাইরে থেকে। এই ভিড়ের বেশির ভাগ মানুষই এসেছেন উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের রক্ত দিতে।
ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের অনেকেই ভর্তি জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। সেখানেই সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছেন রক্ত দিতে।
আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে একটা অ্যাম্বুলেন্স ঢুকল আহত ব্যক্তিদের নিয়ে। পেছন পেছন দৌড়ে গেট পর্যন্ত গেলেন এক নারী। ডুকরে কাঁদছিলেন তিনি। রোগীকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। কিছুক্ষণ পর খানিকটা স্বাভাবিক হলে তাঁর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, ‘রোগী আপনার কী হয়?’
যাত্রাবাড়ী থেকে আসা আফিয়া নামের এই নারী জানালেন, রোগী তাঁর কেউ নন। একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারে যে আগুন লেগেছিল, সেখানে আমার ভাই মারা গেছে। মৃত্যুর একদিন আগে ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা–কাটাকাটি হয়েছিল। তাই ভাইয়ের মৃত্যুটা ভুলতে পারি না। আজকে টিভিতে যখন দেখলাম ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আগুনে পুড়ে গেছে, নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। কারও যদি কোনো সাহায্য লাগে, তাই এসেছি।’
আফিয়ার বয়স হবে পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে আবারও বার্ন ইনস্টিটিউটের বের হওয়ার গেটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখানেই একটি রক্তদাতা গ্রুপের কাছে নিজের নাম লেখাচ্ছিলেন কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্র জোনায়েদ।
স্নাতক চতুর্থ বর্ষের এই ছাত্র বললেন, ‘এখানে অনেক রক্ত লাগবে। বিশেষ করে নেগেটিভ গ্রুপের। আমার রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। মনে হলো, একটা প্রাণ বাঁচাতে যদি অবদান রাখতে পারি, সেটাও তো কম কিছু না।’
জোনায়েদের মতো আরও প্রায় ১৫ জন রক্তদানে আগ্রহী ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলো হাসপাতালের গেটে। সবাই এসেছেন হতাহত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রেহনুমা খানম বললেন, ‘আমরা ছয়জন এসেছি, নাম নিবন্ধন করে গেলাম। জানিয়েছে রক্তের দরকার পড়লেই ফোন করবে।’
স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংস্থা ‘বাঁধন’–এর ঢাকা কলেজ শাখা থেকে আসা ১২ জনের একটি দল তালিকা তৈরি করছিলেন। কেউ প্ল্যাকার্ড ধরে আছেন, কেউ লিখছেন রক্তদানে আগ্রহী ব্যক্তিদের নাম। তাঁদেরই একজন বাঁধন শেখ বললেন, ‘আমরা এরই মধ্যে ৩–৪ হাজার নাম নিবন্ধন করেছি। সাধারণ মানুষের এই সহযোগিতা দেখে ভালো লাগছে।’
রেড ক্রিসেন্ট, বিএনসিসি, বাঁধন, বন্ধুমহল ব্লাড ডোনার সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৈতালি গ্রুপসহ অনেক সংগঠন রক্ত সংগ্রহের কাজটি করছে। তাৎক্ষণিকভাবে শুধু নাম, ফোন নম্বর আর রক্তের গ্রুপ লিখে নেওয়া হচ্ছে।
একটা দলকে দেখা গেল ফুটপাতে বসেই রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করছেন। সেখানেও মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। তবে যাঁরা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন, তাঁদের রক্ত সংগ্রহ করে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
রাস্তার একপাশে রেড ক্রিসেন্টের একটি গাড়ির সামনেও মানুষের ভিড়। কাছে গিয়ে দেখলাম, একাধিক স্বেচ্ছাসেবক সেখানে রক্তদানে আগ্রহীদের নাম লিখছেন। গাড়ির ভেতর একসঙ্গে একাধিকজনের রক্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে।
রেড ক্রিসেন্টের সেচ্ছাসেবক মো. তাওহিদুল ইসলাম বললেন, ‘বিকেল ৬টার মধ্যেই আমরা প্রায় ৫০০ জনের তালিকা সংগ্রহ করেছি। এর মধ্যে বেছে বেছে ঢাকার বাইরে থেকে আসা ও নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত যাঁদের আছে, তাঁদের রক্ত সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে।’
সন্ধ্যা ছয়টার পর থেকে একাধিক স্বেচ্ছাসেবক মাইকে ঘোষণা করতে লাগলেন, ‘আপনারা যাঁরা রক্ত দিতে চান, আগামীকাল সকাল ৮টার দিতে আসুন। আজ আর রক্ত লাগছে না।’
তবে সন্ধ্যার পরও নানা বয়সী মানুষের ভিড় কমছে না, বরং বাড়তে দেখা গেল। সেই দলে নারী–পুরুষ, তরুণ, মাঝবয়সী সবাই আছেন। আহত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যাঁদের কোনো পারিবারিক সম্পর্ক নেই, তাঁরা এসেছেন কেবলই মানবিক আবেদনে সাড়া দিতে।