‘জাস্ট বি ইয়োরসেলফ’ বা ‘নিজের মতো থাকো’—এই পরামর্শ হরহামেশাই শুনি আমরা। নিজের মতো থাকার সহজ অর্থ হচ্ছে, আপনি যেমন, তেমনটাই থাকুন। নিজস্ব সত্তা প্রকাশ করুন। আপনি যা নন, তা হওয়ার চেষ্টা করতে হবে না। পরামর্শটি শুনতে ভালো শোনালেও এ নিয়ে আছে ভিন্নমত। পরামর্শটিকে সরাসরি খারাপ বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মনোচিকিৎসক ও লেখক ব্রিট ফ্র্যাংক। তিনি বলেন, নিজের মতো থাকতে গিয়ে নিজের সত্যিকার ব্যক্তিত্ব খুঁজে বের করার চেষ্টায় হিমশিম খেয়ে বসেন অনেকে। এতে নিজের ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। কেন সব সময় নিজের মতো থাকা উচিত নয়, এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন ফ্র্যাংক। মিলিয়ে দেখতে পারেন নিজের সঙ্গে।
ধরুন, আপনি স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে জিমে যেতে চান, আবার একই সময়ে আপনার শুয়ে টিভি দেখতে ইচ্ছা করছে। আপনার দুটি সত্তা একই সময়ে দুটি বিপরীত ইচ্ছা পোষণ করছে। এতে নিজের মধ্যেই একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। আপনি আদতে কী করবেন, তা নিজেই ঠিক করতে পারছেন না। মনের এই টানাপোড়েন প্রমাণ করে, আপনার মন আদতে জটিল; যেখানে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছাগুলো একসঙ্গে বাস করে। অর্থাৎ আপনি কোনো একক ও নির্দিষ্ট সত্তা নন, বরং বহু সত্তার সমষ্টি। তবে একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করার মানে এই নয় যে আপনি কপট। উল্টো এটিই আপনাকে মানবিক করে তোলে।
একেক সময় আপনার একেকটি সত্তা প্রকাশ পায়। এই মুহূর্তে আপনার বাংলা গান শুনতে ভালো লাগলেও কিছুক্ষণ পর হয়তো ইংরেজি গান শুনতে ইচ্ছা করবে। পারিপার্শ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে সেই মুহূর্তে আপনার সত্তা কেমন হবে। সব সময় বোঝা না গেলেও সত্তার এই পরিবর্তন আপনার আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া আপনি আর লম্বা সময় ঘুমিয়ে ওঠা আপনি—সম্পূর্ণ আলাদা দুই ব্যক্তি।
‘আমি তো শুধু নিজেকে প্রকাশ করছি’—এ ধরনের কথা খারাপ আচরণের অজুহাত
আপনার সব অনুভূতি বৈধ হলেও, সব আচরণ কিন্তু বৈধ নয়। আত্মপ্রকাশ করা মানে এই নয় যে আপনি অন্যের অনুভূতির তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছা তাই বলবেন বা করবেন। আপনি যদি ‘আসল আমি’ হওয়ার নাম করে কারও সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে বসেন, তাহলে সেটি অপ্রয়োজনীয় বিবাদ তৈরি করতে পারে। তাই আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে প্রকাশ করা প্রয়োজন। অন্যের ওপর আপনার আচরণের প্রভাব বিবেচনা করতে হবে। ব্যক্তির প্রতিটি সম্পর্কে এবং কর্মস্থলে এই ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো ‘নিজেকে নেতৃত্ব দেওয়া’। এর মানে হলো আপনি নিজের ভেতরের নানা রকম চরিত্র বা অনুভূতিগুলোকে চিনতে শিখবেন। নিজের রাগ, সহানুভূতিশীলতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, ভালোবাসা ইত্যাদির সঙ্গে নিজেই বোঝাপড়া করবেন এবং এসবকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।
আপনার অনুভূতিগুলো কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রকাশ পাবে, সেটি ঠিক করবেন সচেতনভাবে। নিজেকে এভাবে পরিচালনার মাধ্যমে আপনাকে আরও পরিপক্ব মনে হবে। কোনো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানোর বদলে প্রতিক্রিয়ার পেছনের কারণ বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
১. নিজের বহুমুখী সত্তাকে অনুভব করুন: একটি নির্দিষ্ট সত্তায় নিজেকে আটকে রাখলে সুরক্ষিত মনে হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে তা আপনার ব্যক্তিসত্তার উন্নয়ন ও মানসিকতা এক জায়গায় আটকে দেয়। নিজের ভেতরের বহুমুখী সত্তাকে অনুভব করার মানে হলো আপনি জানেন কখন কোন অংশটি সামনে আনা উচিত।
২. অনুভূতিগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজুন: ‘আসল আমি’ খোঁজার পরিবর্তে নিজের ভেতরের অনুভূতিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করুন। এতে আপনি এমন দিকটি বেছে নিতে পারবেন, যা আপনার মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৩. আত্মসচেতনতা: যা মনে আসছে, তা সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেলাই সব সময় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মনের কোন অংশটি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে, সেটি বুঝে সেই অনুযায়ী ধীরেসুস্থে প্রকাশ করুন।
৪. খোলামেলা নয়, দায়িত্বশীল আচরণ করুন: ‘সত্যিকার অনুভূতি প্রকাশ করলাম’, এমন কাঁচা আবেগ সব সময় ভালো হয় না। আপনার অনুভূতি সত্যি হতে পারে, কিন্তু তা কীভাবে, কখন এবং কোথায় প্রকাশ করছেন, সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল হতে হবে।আপনার আচরণ এমন হতে হবে, এতে যেন সম্পর্ক ভেঙে না গিয়ে বরং জোড়া লাগে।
সূত্র: সিএনবিসি