
প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে ছাপা হয়েছে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কয়েকজন সন্তানের লেখা। এখানে তেমনই একটি লেখা।
সাইকেলের পেছনে বসিয়ে রোজ আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতেন বাবা। স্কুল শেষে নিয়েও আসতেন নিয়ম করে। বাবার সাইকেলের পেছনে বসে স্কুলে যাওয়া-আসা করেই মাধ্যমিক পাস করেছি। সাইকেলে যেতে যেতে ভাবতাম, একদিন বড় হয়ে বাবাকে একটা মোটরসাইকেল কিনে দেব। আমার সেই প্রতিজ্ঞা আমি রেখেছি।
অবশ্য বাবা যে নিজে মোটরসাইকেল কিনতে পারতেন না, তা নয়। কিন্তু ওই যে নিজের জন্য কিছু না করে সন্তানের জন্য সর্বস্বদানের অন্য নাম যে বাবা। নিজের জন্য আসলে তেমন কিছুই করতেন না। আমার আর আমার ভাইয়ের জন্য তাঁর সর্বোচ্চটুকুই করতেন। সব বাবা তাঁর সন্তানের জন্য এমন করেন। তবে আমার বাবার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি ভিন্ন ছিল, তা হলো তাঁর চিন্তা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। তিনি তাঁর ছেলে ও মেয়েকে কখনো আলাদা চোখে দেখেননি। আমাদের দুই ভাই–বোনকে সমান সুযোগ-সুবিধা, সমান অধিকার দিয়ে বড় করেছেন। তাঁর সমসাময়িক অনেকেই যখন মেয়েসন্তানকে অধিক লেখাপড়া করানো বা মেয়ের জন্য অর্থ খরচ করাকে অপচয় মনে করতেন, বাবা সেখানে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য না করে আমার জন্য সর্বোচ্চটুকু করেছেন। আমাদের দুই ভাই-বোনকে সমান চোখে দেখেছেন। কেবল আর্থিক সহযোগিতা নয়, সন্তানের প্রতি একজন বাবার মানসিক সমর্থন না থাকলে কোনো সন্তানই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বিশেষ করে, আমাদের সমাজের মেয়েরা।
আজ আমি যা বা যতটুকু, তার পুরো কৃতিত্ব অবশ্যই আমার বাবার। স্কুলজীবনের একটা ঘটনার কথা মনে আছে। নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন। সে বছর অপ্রত্যাশিতভাবে আমার পরীক্ষার ফল খারাপ হলো। বাবা আমাকে নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন; কিন্তু বললেন না তেমন কিছু। বাবার এই নিশ্চুপ থাকাই আমার ভেতর অন্য রকম শক্তি তৈরি করল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, ভালোভাবে পড়াশোনা করব যেন আমার জন্য বাবার মন আর কখনোই বিষণ্ন না হয়। সেই থেকে চেষ্টা শুরু।
স্কুলে পড়ার সময় একজন আমার বাবাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, মেয়েকে আর্টসে পড়াও, খরচ কম হবে। তারপর কোনো রকমে মাধ্যমিক পাস করলে বিয়ে দিয়ে দাও। মেয়ে মানুষকে এত পড়িয়ে কী লাভ! কিন্তু বাবার চোখে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। ছোটবেলা থেকেই সেটা বুঝতে পারতাম। তবে বাবা কিন্তু কোনো দিন তাঁর স্বপ্নের ভার আমার ওপর চাপিয়ে দেননি। আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চাইলাম। বাবা আমাকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করালেন। মেডিকেলে সুযোগ না পেয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইলাম, তিনি বিনা বাক্যে সমর্থন দিলেন। বিভিন্নজন বাবাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়ানোর জন্য পরামর্শ দিতেন। কিন্তু আমি পড়তে চাইলাম লোকপ্রশাসন। বাবা আমার ইচ্ছাকেই গুরুত্ব দিলেন। লোকপ্রশাসন বিষয়ে ভালো ফল করে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। আমার জীবনে আমার বাবার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি
তানিয়া আফরিন : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ