
রাজধানীর বনানীর কামাল আতাতুর্ক সড়কে পা রাখতেই বাতাসে ভেসে আসে ধূপের গন্ধ, শোনা যায় ঢাকের আওয়াজ। পূজার দিনগুলোয় এই এলাকার নাগরিক কোলাহল খুঁজে নেয় অন্য রকম আনন্দ।
এবার গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজামণ্ডপের সামনে পাওয়া গেল সোঁদা মাটির ঘ্রাণ; আঁচ করা গেল জলের ছন্দ, আগুনের শিখা, বাতাসের দোলা; আর ওপরে সুনীল আকাশ। সব মিলেমিশে তৈরি হয়েছে এক দারুণ আবহ।
এই যে পাঁচ উপাদানের কথা বললাম, এসব মাথায় নিয়েই এবার এই মণ্ডপের থিম ‘পঞ্চভূত’। মানে বৈদিক দর্শনের পাঁচ তত্ত্ব—ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুত (বায়ু) আর ব্যোম (আকাশ) এখানে রূপ নিয়েছে দৃশ্যমান শিল্পে।
শিল্পী পার্থপ্রতীম সাহার শিল্পভাবনায় এ বছরের মণ্ডপ কেবল একটি উৎসব আয়োজন নয়; বরং এক দার্শনিক অভিজ্ঞতাই বলা চলে। মণ্ডপের প্রবেশপথে পাটকাঠি আর বাঁশের নানারকম বুনন দর্শককে মনে করায় পৃথিবীর (ক্ষিতি) ঘ্রাণ।
ভেতরে ঝুলছে অলংকৃত নিশান, যেন অপ (জল) আনমনে খেলছে মণ্ডপে। সূর্যের আলো ঝলকাচ্ছে বুননের ফাঁক গলে, লাল রঙের দৃঢ়বন্ধনী দাঁড়িয়ে আছে শক্তি আর তেজের (আগুন) মূর্ত প্রতীক হয়ে।
খোলা প্রাঙ্গণে জালি করা সাদা রঙের পাতাগুলো তুলার মেঘে মিশে শ্বাস নিচ্ছে বাতাসে (মরুত)। আর মণ্ডপের চূড়ায় মহাশূন্যের (ব্যোম) এক মহাবৃত্ত, তার বিস্তৃতিজুড়ে অসংখ্য আলোকবিন্দু যেন মহাকাশের তারার মতো প্রসারিত।
এই মণ্ডপে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে যেন আপনি একেকটি গল্পের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পদ্মফুলের আদলে গড়া প্রতিমার চালচিত্রে আছে লোকশিল্পের আরেক দৃশ্যকাব্য; প্রতিটি অলংকরণ যেন বলছে আমাদের মাটি, শিকড় ও ঐতিহ্যের স্মৃতিভান্ডারের কথা।
এই মণ্ডপের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো পরিবেশভাবনা। এখানে উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বাঁশ, খড়, পাট, মাটি ও কাপড়ের মতো দেশি ও বায়োডিগ্রেডেবল উপাদান। এসব মোটিফ ও অবয়ব দেশের সাতটি জেলার কারিগর ও কারুশিল্পীদের হাতে তৈরি।
মণ্ডপের জন্য বাঁশের বুনন সাতক্ষীরা থেকে, হোগলা বা মলোই এসেছে পিরোজপুর থেকে, পাটি তৈরি হয়েছে বগুড়ার শিল্পীদের হাতে, পাটকাঠি আনা হয়েছে নড়াইলের কৃষকদের কাছ থেকে, লাল মাটি এসেছে টাঙ্গাইল থেকে, কাঠ আনা হয়েছে বাগেরহাট থেকে আর চার রকমের বাঁশ এসেছে যশোর থেকে।
এমন ভাবনায় এবারের মণ্ডপ তৈরি হয়েছে যে পূজার শেষে মণ্ডপের অধিকাংশ উপকরণই পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাবে। এই ভাবনা যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পূজা মানেই শুধু ভক্তি নয়, প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতাও।
শেষ পর্যন্ত সবকিছু মিলেমিশে এক জায়গায় এসে দাঁড়ায় দেবীর সর্বমঙ্গলা রূপে। ধূপের ধোঁয়া, আলোছায়া, শিল্পকলা আর প্রকৃতির উপাদানগুলো একত্রে যেন সেই প্রাচীন মন্ত্রকেই দৃশ্যমান করে তোলে, ‘সর্বমঙ্গল মাঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে, শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণী নমোন্ডুতে।’
এখানে দেবী শুধু প্রতিমায় সীমাবদ্ধ নন, তিনি আছেন বাতাসে, জলে, মাটিতে, আলোতে আর অসীম আকাশে।
গুলশান-বনানীর এই পূজামণ্ডপ আদতে একটি প্রতীক। এটি বলে দেয়, শিল্প যখন দর্শনের সঙ্গে মেশে আর দর্শন যখন পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ হয়, তখন পূজা হয়ে ওঠে সর্বজনীন।
শিল্পী পার্থপ্রতীম সাহা ও ‘কারিকরি কারখানা’র কারুশিল্পীর দল রাতদিন পরিশ্রম করে দেখিয়েছেন পূজা মানে শুধু আচার নয়, এটি প্রকৃতি রক্ষার অঙ্গীকার, সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ।
এবারের ফাউন্ডেশনের সভাপতি জে এল ভৌমিক ও সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার জোয়ারদারের একান্ত ইচ্ছা ছিল, এই মণ্ডপে আগতরা যেন কেবল দর্শক না হয়ে প্রকৃতির সহযাত্রী হয়ে ওঠেন।
অমিতি কুন্ডু, আহ্বায়ক, মণ্ডপ ও প্রকৌশলবিষয়ক উপপরিষদ, গুলশান-বনানী সার্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশন