ইলিশের যে স্বাদ এখনো আমাকে ভীষণভাবে স্মৃতিকাতর করে

শৈবাল সাহা, ডিজাইনার ও ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক
ছবি: খালেদ সরকার

সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি লেখায় রয়েছে, বিদ্রোহ দমনে বিশাল নৌবহর নিয়ে গুজরাটে যাচ্ছিলেন দিল্লির সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলক। হঠাৎ এক বিকেলে ঝকঝকে এক রুপালি মাছ লাফিয়ে জল থেকে নৌকায় উঠল। বর্ণনা পড়ে মনে হয়, সেটা ছিল ইলিশ। তিনি আদেশ দিলেন, মাছটিকে কেটে রান্না করা হোক। সুস্বাদু সেই মাছ খেয়ে নানা ঘটনার সূত্রপাত। এসব ৭০০ বছর আগের ঘটনা।

আবার মনসামঙ্গল কাব্য–তে ‘তারকা’ নামে যে চরিত্র রয়েছে, সে তার নন্দাই অর্থাৎ লখিন্দরের জন্য শর্ষের শাক দিয়ে ইলিশের মাথা রান্না করে। এসব থেকে বোঝা যায় যে ইলিশের জনপ্রিয়তা আজকের নয়। রান্নায় দুই বাংলাতেই ইলিশের তুল্য জনপ্রিয় মাছ আর দ্বিতীয়টি নেই। এই ইলিশকে ঘিরে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া কত কিছুই না তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে পদ্মার ইলিশ ও গঙ্গার ইলিশের মধ্যে কোনটা বেশি সুস্বাদু, দুই বাংলার মধ্যকার এ তর্কের মীমাংসা আজও হয়নি।

শৈবাল সাহার ব্যক্তিগত প্রিয় মাছের তালিকায় সর্বশ্রেষ্ঠ মাছ ইলিশ

নিজের খাদ্য অভিজ্ঞতায় ইলিশের একটি স্বাদ এখনো আমাকে ভীষণভাবে স্মৃতিকাতর করে। স্বাধীনতার পর সেবার বাংলাদেশ থেকে স্থলপথে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় যাচ্ছিলাম। আমাদের নিবাস ছিল চট্টগ্রামে। সেখান থেকে ট্রেনে চড়ে চাঁদপুর। তখন স্টিমারে গোয়ালন্দ হয়ে পদ্মার ওপর দিয়ে ওপারে গিয়ে কলকাতায় যেতে হতো। চাঁদপুরে স্টেশনে নেমে স্টিমারে ওঠার আগে একটা ভাতের হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিই আমরা। খাবার তালিকায় ছিল ভাত আর ইলিশ মাছের ঝোল। ইলিশের পাতলা জিরার ঝোলের সেই স্বাদ আর হাতে লেগে থাকা মাছের তেলের গন্ধ আমার এখনো ভীষণ মনে পড়ে। অদ্ভুত এক স্বাদ, ইলিশের সেই স্বাদ এখন আমি কদাচিৎ পাই।

আমার কাছে ব্যক্তিগত প্রিয় মাছের তালিকায় সর্বশ্রেষ্ঠ মাছ ইলিশ। ইলিশের একটা নিজস্ব গন্ধ রয়েছে, যার রেশ থেকে যায় দীর্ঘক্ষণ। অন্য কোনো মাছ যদি আপনি বাড়িতে রান্না করেন, তার সুগন্ধ তেমন ছড়ায় না। কিন্তু পদ্মার ইলিশ রান্না করলে সেটার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়িতে। কথায়ই তো আছে, ‘ইলিশ ভাজলে গন্ধ ছড়ায়, শর্ষে–ইলিশ মন ভোলায়।’ তাই রান্নার সময়ই লক্ষ রাখতে হবে যে ইলিশের গন্ধ যেন উধাও হয়ে না যায়। আমি যখন ইলিশের কোনো রেসিপি বানাই, বিশেষ লক্ষ রাখি, ইলিশের নিজস্বতা যেন হারিয়ে না যায়। তাই আমার ভীষণ প্রিয় পাতলা জিরা আর কাঁচামরিচের ফোড়নে ইলিশের ঝোল।

অথবা কাঁকরোল বা বেগুন দিয়ে ইলিশের ঝোল, গরম ভাতের সঙ্গে খেতে যা অমৃত। ইলিশ ভাপা, ইলিশ পাতুরি আর জলকচু দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোলের মতো ঐতিহ্যবাহী ইলিশ রান্নায় কোনো পরিবর্তনে আমি আগ্রহী নই। কারণ, ঐতিহ্যবাহী এসব রান্নার পদ ইতিহাস বহন করে। এগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অনেক গল্প, অনেক অজানা তথ্য।

ঐতিহ্যবাহী এসব ইলিশ রান্নার পদ বহন করে ইতিহাস

ইলিশ দিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কিছু রান্নাও আমি করে থাকি। তবে আবার আগের কথার রেশ ধরে বলছি, গন্ধের ব্যাপারে আপস করি না। আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে যেসব রেসিপি আমি করি, তার মধ্যে আছে কুমড়োপাতায় ইলিশের ভাপা, কলাপাতায় ভাত পাতুরি, ইলিশ ও টক দই রাধাবল্লভী, ইলিশ বড়ার টক ঝোল। এসব পদ আমি আমার নিজস্ব মনন থেকে করে থাকি। এগুলোকে বলতে পারেন আমার সিগনেচার খাবার। আরেকটা কথা—বর্ষাতেই আসলে খোলতাই হয় ইলিশের স্বাদ।

বর্ষায় যেসব সবজি পাওয়া যায়, সেগুলো দিয়ে তৈরি করা যায় ইলিশের সুস্বাদু সব পদ। আর একটি খুবই জনপ্রিয় পদ ইলিশ–পোলাও। ইলিশের মাছের মাথা দিয়ে কচুশাক অপূর্ব। ইলিশ মাছের মাথা ও মাছের ডিমে আলু যোগ করে করা হয় একটি রান্না। ইলিশ ভাজা ও মাছভাজার তেল দিয়ে সাদা ভাত মেখে খাওয়ার আনন্দই আলাদা। ইলিশ রান্নায় নদী তীরবর্তী অঞ্চলে আয়োজন হয় ব্যাপক। ভরা বর্ষায় সেই সব অঞ্চলে হয় ইলিশ পার্বণ।

ইলিশ মাছ শুধু সুস্বাদুই নয়, পুষ্টিগুণেও ভরপুর। এতে আছে ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। আছে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজ। ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে। স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে। ইলিশে থাকা ভিটামিন সি ও কোলাজেন ত্বককে সুস্থ ও তারুণ্যদীপ্ত রাখতে সাহায্য করে। ইলিশ মাছ ভিটামিন ডির ভালো উৎস, যা হাড় ও দাঁতের জন্য প্রয়োজন। তবে যেকোনো খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ করলে হিতে বিপরীত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই সবকিছুর মধ্যে একটা পরিমিতিবোধ থাকা খুবই জরুরি। বিশেষ করে ইলিশ মাছে যেহেতু অনেক চর্বি, তাই রান্নার সময় ইলিশ থেকেই অনেক তেল বের হয়। তাই ইলিশ মাছ রান্নায় তেল ব্যবহারের সময় বিশেষভাবে সচেতন থাকতে হবে।

নাকভাঙা ইলিশই হলো আসল পদ্মার ইলিশ

ইলিশ মূলত লোনা পানির মাছ। ইলিশ প্রজননের জন্য প্রয়োজন কতকগুলো প্রাকৃতিক অবকাঠামো। বাংলাদেশ সেই অবকাঠামোতে ভীষণ উপযুক্ত। ইলিশের প্রজননে যে ধরনের পরিবেশ দরকার, নদীমাতৃক বাংলাদেশে তা বিদ্যমান। বঙ্গোপসাগর থেকে নদীতে প্রবেশের পথে লবণাক্ততার ক্রমিক পরিবর্তন ইলিশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।

পাকশীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে ইলিশের নাক নাকি থেঁতো হয়। নাকভাঙা সেই ইলিশই হলো আসল পদ্মার ইলিশ। তবে যত সময় যাচ্ছে, ইলিশের বৃদ্ধির পরিবেশ ও প্রজননের ধারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে তৈরি হচ্ছে নানা রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং নদী হারাচ্ছে নাব্যতা। ফলে কমে যাচ্ছে ইলিশের সংখ্যা। এতে সাধারণ মানুষের কাছে মাছটি হয়ে পড়ছে দুর্লভ। তারপরও আমাদের চাওয়া—সবাই পাক ইলিশের স্বাদ।

লেখক: ডিজাইনার ও ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক