ছয়টা বাজলেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে সাচিকো। এরপর জিম, সনা নেওয়া শেষে হেঁটে বাড়ি ফেরা। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যালরি তাকে খরচ করতেই হবে। কারণ, খাবার উপভোগের জন্য ক্ষুধা লাগতে হবে। বাসার কাছেই সুপারমার্কেট। সেখান থেকে রোজ তাজা বাজার। কোনো দিন মুরগি, কোনো দিন মাছ। সঙ্গে নানা রকম সবজি। বাড়ি ফিরে রান্না চড়াবে। প্যানে অল্প তেলে পাতলা স্টেক পিসের দুপাশ ঠিক একই রকম বাদামি হবে। সবজিও সেদ্ধ কিংবা সামান্য সতে হবে। ফিশ সস, লাল চিনি কিংবা আরও নানা কিছুর মিশ্রণে তৈরি হবে সস। রোজ একই রুটিন, খাবারগুলো নতুন। আর এত সব আয়োজন শুধুই নিজের জন্য।
কতক্ষণ ধরে শুধু এই ক্লিপগুলো দেখছিলাম, মনে নেই। কোন দেশের সিরিজ জানি না। মন্তব্য পড়ে মনে হলো জাপানিজ কিংবা কোরিয়ান। ‘সাচিকো ইটস’ নামে সার্চ দিলেই চলে আসবে। এই ক্লিপগুলোতে দেখা বেশির ভাগ খাবারই আমার পরিচিত নয়। উপকরণ, রান্নার পদ্ধতিও অচেনা। তবু সাচিকোর সঙ্গে রাতের খাবারের আমন্ত্রণ পেলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে মনে হচ্ছিল!
অবশ্য যে খাবারগুলো মিলেনিয়াল আমার অচেনা, ঢাকার জেন–জির কাছে সেগুলো এখন ডালভাত। এক যুগ আগে সাউথ কোরিয়ায় খেয়ে আসা কিমচি যে ঢাকায় একসময় এত জনপ্রিয় হবে, বুঝিনি। কিংবা কাঁচা মাছ দিয়ে বানানো সুশি! অবশ্য কাঁচা মাছ বললে একটু অবিচার হয়। সুশি তৈরির মাছ বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করা হয়। তবু ভাবুন তো, রান্না করলেও মাছের গন্ধ থাকে বলে তরকারিতে একটু লেবুপাতা ছেড়ে দেওয়া কিংবা মাছটাই একটু ভেজে রান্না করা বাঙালি রেস্তোরাঁয় গিয়ে ভাতের ওপর একটুকরো কাঁচা মাছ বসানো সুশি খাচ্ছে!
কিংবা ছুটির দিনে দুপুরে কষানো মসলায় নেড়েচেড়ে তৈরি ভুনা মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে রাতে বন্ধুদের সঙ্গে খাচ্ছে হটপট-গরম পানিতে পাতলা মাংসের স্লাইস, মাশরুম, আরও নানা সবজি। টেবিলের ওপর রাখা বোলে নিজেই আবার সেটি বানিয়ে নিচ্ছে! প্যাকেটের মসলায় নেড়েচেড়ে দুই মিনিটে নুডলস বানিয়ে নেওয়া মানুষটিই কত কিছু দিয়ে বানাচ্ছে রামেন।
ডেজার্ট আর ড্রিংকেও কমতি নেই। ঢাকায় এখন চটপটি-ফুচকার দোকানের চেয়েও বেশি বোধ হয় ওয়াফল। রেস্তোরাঁর মেনুতে সোডা বা সফট ড্রিংকের পাশাপাশি মকটেল, স্মুদি, স্লাশের দুই তিন পাতা লিস্ট। এবার দেখলাম চলে এসেছে বোবা টি, মাচা ড্রিংকও।
রাইস বোল, মিট বক্স, পোকে বোল, বেন্টো বক্স তো কবে থেকেই জনপ্রিয়। শর্করা, আমিষ, স্নেহ, খনিজ, ভিটামিন, পানি—এক বাটিতে সব খাদ্য উপকরণ পাওয়া গেলে আর কী চাই!
যা-ই ট্রেন্ড আসুক, নতুন যা-ই জনপ্রিয় হোক, তার পেছনে আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এ তো আর নতুন কথা নয়। সারা দুনিয়ার ফুড ব্লগার, ক্রিটিক, ফটোগ্রাফার তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ করুন মুকবাং বা ক্যামেরার সামনে অনবরত খেয়ে চলার ইনফ্লুয়েন্সারদের। দেশ, জাতির গণ্ডি অতিক্রম করা এত রকম খাবার জনপ্রিয় হওয়ার এটা একটা বড় কারণ।
মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে এখন অনেক আন্তর্জাতিক ফুড ব্লগার আসছেন। আর তাঁরা কিন্তু খাচ্ছেন ও ভিডিওতে দেখাচ্ছেন পুরান ঢাকার বিরিয়ানি, তেহারি, মেজবানি, শর্ষে ইলিশ। এই ভিডিগুলো দেখে হয়তো নর্থ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ার কোনো দেশের তরুণেরা ভাবছেন, ‘বাংলাদেশি খাবার, দারুণ তো!’ এখানে আবার উল্টোটা হচ্ছে।
তরুণেরা কেন নতুন নতুন খাবারে আগ্রহী হচ্ছেন? আরও একটু তথ্য পাওয়ার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধির অ্যাপকে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল আরেকটা কারণ—জেন–জি বা তরুণেরা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পছন্দ করেন। যেমন কিমচি শুধু স্বাদেই নতুন নয়, এটি প্রোবায়োটিক হওয়ায় হজমেও সহায়ক।
খাবার উৎপাদনের পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব কি না, সেটাও ভেবে দেখেন তাঁরা। এ কারণেই মাছ-মাংস কম খাওয়া কিংবা একদম না খাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আমিষের উৎস হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে বাদাম, বিন, সয়া ইত্যাদি। বাংলাদেশের তরুণদের বেলায়ও কি ব্যাপারটা সত্যি?
মিট বক্সে মাংসের বদলে কেউ কি বেছে নিচ্ছে, সয়া? চা-কফিতে গরুর দুধের বদলে কাঠবাদাম কিংবা ওটমিল্ক? সে পর্যন্ত যেতে বোধ হয় আরেকটু সময় লাগবে।
কাচ্চি বিরিয়ানি, ইলিশ পোলাও, ভুনা খিচুড়ি, রসমালাই, লেবুর শরবত আমাদের ‘কমফোর্ট ফুড’ হিসেবে থাকবেই। সেটা কাচ্চি ভাই, ভাবি, বোন, আপা…এত রকম রেস্তোরাঁ চলতে দেখেই বোঝা যায়। নান্না মিয়া, হাজীর বিরিয়ানি, বিউটির শরবত হারায়নি, বরং নতুন নতুন শাখা খুলছে নতুন ঢাকায়। স্টার হোটেলের ঐতিহ্যবাহী নাশতার আদলে সকালের নাশতা পাওয়া যাচ্ছে অনেক রেস্তোরাঁয়।
এর সঙ্গেই চলবে ‘গ্লোবাল ইজ দ্য নিউ লোকাল’ স্লোগানমতে শর্ষের তেলের ঝাঁজে বানানো কিমচি, পানিপুরি আর ফুচকার ফিউশন, তন্দুরি পিৎজা। তবে বেশ কিছুদিন পর ঢাকায় গিয়ে বইমেলায় চিংড়ির মাথা ভাজা খুঁজে না পেয়ে মোমো খেতে হলো, সত্তর-আশি রকম চায়ের ভিড়ে টঙের চায়ের স্বাদটাই পাওয়া গেল না, আর দই-ফুচকা, নাগা ফুচকা, চুরমুর ইত্যাদির ভিড়ে একগাদা কাঁচা মরিচ, ঝুরো ডিম সেদ্ধ দেওয়া চটপটি-ফুচকা পেতে কত জায়গায় ঢুঁ দিতে হলো বলে মিলেনিয়াল মন একটু কেমন করে উঠল!