‘নীলার গলাটা কী মিষ্টি, দেখেছ?’
‘নীলা! নীলা কে?’
‘আরে মাহী ভাবির ছোট বোন, হান্নানের শ্যালিকা, কাল রাতে পার্টিটা তো ও একাই জমিয়ে দিল...।’
‘ও হ্যাঁ, ভালো গেয়েছে মেয়েটা, মৌসুমী ভৌমিকের সেই গানটা—আমি শুনেছি সেদিন তুমি...।’
‘কেন, আরও কয়েকটা গাইল তো, দারুণ! আমার তো মনে হয় আজকাল টিভি চ্যানেলে যারা নিয়মিত গায়, ওদের চেয়েও ভালো...।’
‘হ্যাঁ।’
‘আর ড্রেসসেন্সও কী চমত্কার বলো, গাঢ় সবুজ শাড়ি, হালকা সবুজ ব্লাউজ, কপালে একটা সবুজ টিপ...।’
এবার একটু অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকাল শায়লা। অফিসে যাওয়ার জন্য দ্রুত তৈরি হচ্ছে আদনান। শার্ট-প্যান্ট পরা শেষ, এখন টাইয়ের গিঁট ঠিক করতে করতে কথা বলছে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও গত রাতের হান্নান-মাহীর বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলছিল উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে। তবে পুরো অনুষ্ঠান নিয়ে যতটা নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি নীলা প্রসঙ্গে।
একটু চিনচিন করে উঠল বুকের ভেতর। ঈর্ষা? না, ঠিক তা নয়, কেমন যেন তিতকুটে একটা অনুভূতিতে ভরে গেল মন। বেরিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে হঠাৎই আদনানকে প্রশ্ন করে বসল, ‘আচ্ছা আদনান, আমি কাল কী পরে পার্টিতে গিয়েছিলাম, বলো তো?’
ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, ‘তুমি? কেন, শাড়ি পরেছিলে...কী রং যেন…তোমার এত সব শাড়ি…মনেও রাখতে পারি না আজকাল। আমার দেরি হয়ে গেল, যাচ্ছি...।’
আদনানের গমনপথের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শায়লা। লাল সালোয়ার-কামিজ পরেছিল সে কাল। শীতটা জাঁকিয়ে নেমেছে বলে, একটা ক্রিম রঙের কার্ডিগানও চাপিয়েছিল গায়ে। এসব মনে নেই আদনানের। তার চোখে ভাসছে হালকা সবুজ আর গাঢ় সবুজের অপূর্ব ম্যাচিং, আর কানে লেগে আছে মৌসুমী ভৌমিকের গান!
সকালে প্রাতরাশের সময় পরোটা-ডিমভাজির সঙ্গে আজ একটু পায়েস রান্না করেছিল। গুড়ের পায়েস রান্নার রেসিপিটা শিখেছে ‘নকশা’ পড়ে। আদনান দিব্যি চেটেপুটে শেষ করল এক বাটি পায়েস। কিন্তু ভালো-মন্দ স্বাদ নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। যেন সে প্রতিদিনই সকালের নাশতায় গুড়ের পায়েস খেয়ে অভ্যস্ত!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক ফুঁড়ে, বিয়ের আগে এই লোকটারই মুখে ছিল তার রূপ-গুণের প্রশংসায় ফুলঝুরি। তিন বছরও পেরোয়নি, এর ভেতরই শুকিয়ে গেল সেই ফুল!
তানিয়ার জন্মদিনে কী উপহার দেওয়া যায়, ভাবছিল শিহাব। শেষে নতুন একটি আইডিয়া পেয়ে নিজেই উল্লসিত হয়ে উঠল। ফেসবুক থেকে তানিয়ার প্রোফাইল ছবিটা নিয়ে প্রিন্ট করল। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করত। সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্য পোস্টার লেখার দায়টা প্রায় নিয়মিত চাপত তার ওপর। এত দিন পর সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তানিয়ার ছবির নিচে রবি ঠাকুরের ভাষায় লিখল, ‘আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান।’
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে একবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াবেই তানিয়া। সেখানেই একগোছা ফুলসহ রেখে দিয়েছিল ছবি ও কবিতার বাঁধাই করা ফ্রেমটি। ভেবেছিল চমকে উঠবে তানিয়া। ছুটে এসে আলিঙ্গন না হোক, অন্তত গভীর আবেগে হাতটা একবার ধরবে। সেই সব কিছুই হলো না। চোখে পড়েছে, কিন্তু হাতে নিয়ে দেখল না। শুধু শুয়ে পড়ার আগে একবার নিরাবেগ কণ্ঠে বলেছিল, ‘থ্যাংকিউ।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে যে মেয়েটা শিহাবের রাজনৈতিক বক্তৃতা শুনত মুগ্ধ-বিস্ময়ে, তার সামান্যটুকুও যে আজ আর অবশিষ্ট নেই, সেটা বুঝতে পেরেছিল আড়াল থেকে শোনা তার ফোনালাপে। কাকে যেন ঠাট্টার গলায় বলেছিল, ‘আরে না, ওসব কিছু না, ফটো ফ্রেম, একটা ফটো ফ্রেম দিয়েছে তোর ভাই। ভেবে দ্যাখ, আজকালকার দিনে ফটো ফ্রেম...হি হি হি।’
খুব বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল শিহাব। শুধু জন্মদিনের বিষয়টি নয়, মুখ ফুটে না বললেও ইদানীং সব ব্যাপারেই কেমন একটা অবহেলা, অবজ্ঞা, উপেক্ষা দেহভাষায় যেন বুঝিয়ে দেয় তানিয়া।
প্রিয় পাঠক, পরিচয় গোপন রেখে, ছদ্মনাম ব্যবহার করে এখানে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলাম। খুব সাধারণ ঘটনা, আমাদের চারপাশে হরদম ঘটছে। নিশ্চয় এ রকম অনেক ঘটনার কথা নিজেও জানেন আপনি। কিন্তু এই যে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি ছোট ছোট উপেক্ষা, এর পরিণতি কি অনুমান করতে পারেন? এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক জিন্নাত ডি লায়লা বললেন, ‘স্বামী-স্ত্রী যদি পরস্পরের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ে, কোনো এক পক্ষ অন্যকে অবহেলা বা উপেক্ষা করতে থাকে, ছোট ছোট ক্ষোভ-দুঃখ-অভিমান জমা হয়ে কিন্তু অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ধরুন, এমন যদি হয়, স্বামী বা স্ত্রী ঘরে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটার কাছে মনোযোগ পাচ্ছে না, কিন্তু অন্য কারও কাছে যথেষ্ট মূল্য পাচ্ছে, প্রশংসা বা স্তুতি পাচ্ছে, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার মনের পরিবর্তন আসবে, সেই মানুষটার প্রতি তার একধরনের দুর্বলতা জন্মাবে। এভাবেই অনেকে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এমনকি বিবাহবিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়াতে পারে এ সম্পর্ক। এ ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হচ্ছে, ঘরের মানুষটাকে অন্যের তুলনায় খাটো ভাববেন না, তাঁকে উপেক্ষা করবেন না। বরং পরস্পরকে সময় দিন, যাকে আমরা বলি কোয়ালিটি টাইম। মনে রাখতে হবে, সম্পর্ক একটা চর্চার বিষয়।’
এই মনোবিদের ‘ব্যবস্থাপত্র’ অনুসরণ করে আমরাও বলতে চাই, আপনার স্বামী বাথরুমে শেভ করতে করতে গুনগুন করে গান গাওয়ার সময় তাঁর কাছে গিয়ে আন্তরিক সুরে বলুন, তোমার গানের গলাটা খুব ভালো। স্ত্রীর সাজপোশাকটা ভালো করে দেখুন, কেমন দেখাচ্ছে বলুন, তাঁর রান্নার প্রশংসা করুন, এমনকি তাঁর সবদিক ম্যানেজ করার ক্ষমতারও প্রশংসা করতে পারেন।
ভাবছেন মিথ্যা বলব কেন? না, মিথ্যা বলার দরকার নেই। বরং সত্যিকার অর্থে তাঁর কী গুণটা আছে, সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। সব মানুষেরই কিছু না কিছু গুণ আছে। সঙ্গীর গুণের কথা মনের ভেতর রেখে না দিয়ে মুখ ফুটে বলুন। উপেক্ষা করবেন না। এই উপেক্ষা থেকে জমতে থাকে অভিযোগ। সেই অভিযোগ পরস্পরকে অনেক দূরে সরিয়ে নেয়। তার আগেই আমাদের চেষ্টা করতে হবে কাছে আসার, ভালোবাসার।