‘আমি ওই নারীর মোহ থেকে ফিরে এসে প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চাই’

পাঠকের প্রশ্ন বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন পাঠিয়েছেন পাঠকেরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মিতি সানজানা
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন: আমি একজন পুরুষ, বয়স ২৭ বছর। আমার একটি আর্থিক লেনদেনের (বিকাশ, নগদ) দোকান আছে। ছয় মাস আগে এক নারীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় মোবাইলে টাকা তুলতে আসার পর। স্বামী বিদেশে থাকেন। উনি আমার চেয়ে বয়সে ১৫ বছরের বড়। দোকানে পরিচয়ের পর থেকে ফোনে কথা বলা, এরপর বাইরে দেখা করাসহ বিভিন্ন সময়ে ভিডিও কলে কথা বলতে থাকি। ওনার সঙ্গে আমার ঠিক প্রেমের সম্পর্ক নয়। তাঁর ছেলেমেয়েরাও বেশ বড় বড়। এদিকে আমার তিন বছরের একটি প্রেমের সম্পর্ক আছে। তবে এই নারীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুদিন পর অন্তরঙ্গ হয়, বিভিন্ন জায়গায় ওনার সঙ্গে একান্তে দেখা করি। উনিও জানেন আমাদের মধ্যে প্রেম–বিয়ের সম্ভাবনা নেই। তারপরও আমরা কথা বলে যাচ্ছি।

ইদানীং আমার প্রেমিকার সঙ্গে কথা বলা, দেখা করা নিয়ে উনি (ওই নারী) নানা রকম ঝামেলা করছেন। তিনি চান, আমি শুধু তাঁর সঙ্গেই কথা বলি। কিন্তু আমি আমার প্রেমিকাকে নিয়ে সিরিয়াস, ওকেই বিয়ে করতে চাই। তবে তার আগে আমি ওই নারীর কাছ থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কিন্তু দু–তিন দিন কথা না বললে ওই নারী আমার দোকানে চলে আসেন। আমাকে হুমকি দেন। সবাইকে সবকিছু জানিয়ে দেবেন, আমাকে ফাঁসিয়ে দেবেন বলে ভয় দেখাচ্ছেন। এসব কথার রেকর্ডও আমার কাছে আছে। বিষয়টি জানাজানি হোক, আমি সেটা চাইছি না। এখন আমি কি কোনো আইনি সাহায্য পেতে পারি? আমি ওই নারীর মোহ থেকে ফিরে এসে প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চাই। এ ক্ষেত্রে আমি কি একটা জিডি করে রাখলেই হবে?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সারিয়াকান্দি, বগুড়া

পরামর্শ: আপনার প্রশ্ন থেকে বোঝা যাচ্ছে, ওই নারী সম্পর্ক চালিয়ে যেতে আপনাকে বাধ্য করতে চাচ্ছেন। সেই সঙ্গে তিনি আপনাকে হুমকি প্রদর্শন করছেন এবং সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন।

কেউ হুমকির শিকার হলে তাঁকে অবশ্যই থানায় গিয়ে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করতে হবে। এই সাধারণ ডায়েরির ভিত্তিতে পুলিশ প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেবে। হুমকির শিকার ব্যক্তি দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারার ক্ষমতাবলে সরাসরি আদালতেও অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। তবে জিডি করলে পুলিশ ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে নন–এফআইআর প্রসিকিউশন দাখিল করতে পারে। জিডির পর পুলিশ তদন্ত করবে। যদি তদন্ত করে দেখা যায় হুমকি দেওয়ার ঘটনা সঠিক, তাহলে হুমকিদাতার বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর জন্য দণ্ডবিধির ৫০৬ ধারায় প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। ৫০৬ ধারার অধীনে অপরাধমূলক হুমকির জন্য শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত।

কেউ হুমকি দিলে, ভয়ভীতি দেখালে বা বিরক্তিকর কোনো কাজের আশঙ্কা দেখা দিলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৭ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চাওয়া যায়। ১০৭ ধারায় মামলা করার মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শান্তি বজায় রাখার জন্য বন্ড সম্পাদনে বাধ্য করা যায়। এ ধরনের মামলা করতে হয় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। আপনি যদি নিরাপত্তার অভাববোধ করেন, তবে সে ক্ষেত্রে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে আরজি উপস্থাপন করবেন। আরজিতে মূল অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম–ঠিকানাসহ সব ঘটনার বিবরণ স্পষ্ট করে লিখতে হবে। আপনার অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ থাকলে, তা আরজির সঙ্গে দাখিল করতে হবে।

১০৭ ধারায় আশ্রয় নিলে আদালত প্রাথমিক শুনানিতে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মুচলেকা সম্পাদনের জন্য আদেশ দেবেন। ভবিষ্যতে তিনি আর কোনো ধরনের হুমকি বা ভয়ভীতি দেখাবেন না, এই মর্মে অঙ্গীকারনামা দিতে হবে।

তা ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত)–এর ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কারও ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তা ছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি ২৫০ ধারায় মিথ্যা মামলার শাস্তির বিধান রয়েছে। ২৫০ ধারায় বলা আছে, ম্যাজিস্ট্রেট যদি আসামিকে খালাস দেওয়ার সময় প্রমাণ পান যে মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিশসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। দণ্ডবিধির ১৯১ থেকে ১৯৬ ধারা পর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষ্যদান, মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি ও মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে।

আপনি ওই নারীকে এ ধরনের বেআইনি কাজ থেকে বিরত থাকতে বলুন। এরপরও তিনি এ ধরনের হুমকি দিলে বা খারাপ আচরণ করলে এসব কথা উল্লেখে আপনি কাছের থানাকে অবহিত করে একটি সাধারণ ডায়েরি করে রাখতে পারেন। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি বুঝে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।

এটা তো গেল আইনের কথা। তবে আপনার প্রশ্ন থেকে আরও একটি বিষয় পরিষ্কার যে আপনার প্রেমিকা থাকা অবস্থাতেই আপনি ওই নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। যেখানে আপনারও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার ছিল। ঘনিষ্ঠ হওয়ার আগেই একটা সীমারেখা টেনে রাখলে আজ হয়তো ঘটনা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছাত না।