
পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট রাউফুন নাহার নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।
প্রশ্ন: আমার বিয়ে হয়েছে ১০ বছর। শ্বশুরবাড়িতেই থাকি। স্বামীর চাকরির কারণে লম্বা সময় ধরে একসঙ্গে থাকতে পারি না। তিনি থাকেন ঢাকায়। দুই ঈদ ছাড়া বছরে তিন থেকে চারবার ছুটিতে আসেন কয়েক দিনের জন্য।
আমাদের সাত বছরের একটি সন্তান আছে। আমার স্বামী বেশ ভালো। তবে এত বছরেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব বা খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। স্বামীর তুলনায় আমার বরং দেবরের সঙ্গেই বন্ধুত্ব বেশি। তবে সেটা কোনো অনৈতিক সম্পর্ক নয়। মাঝেমধ্যে এমন পরিবেশ তৈরি হলেও আমরা নিজেদের সামলে নিয়েছি।
দেবর পড়াশোনার কারণে বাড়িতে থাকায় সব দরকারে তাকে কাছে পাই, সন্তানের দেখভালেও সে আমাকে সাহায্য করে। বিয়ের পর আমি পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। বিএ পাস করেছি। এই সময়ে দেবর আমাকে কলেজেও আনা–নেওয়া করত। গত এক বছর সে আমার ছেলেকেও স্কুলে আনা–নেওয়া করেছে।
দেবর দুই মাস আগে পড়াশোনার কারণে বাড়ি ছেড়েছে। এর পর থেকে আমার খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে, আমি তার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। হয়তো স্বামীর চেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে আমার আসলে কী করার আছে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
উত্তর: মনের কথাগুলো আমাদের গুছিয়ে বলার জন্য ধন্যবাদ। প্রত্যেক মানুষেরই ভালোবাসা, মায়া–মমতা, মনোযোগ, সঙ্গ ও সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। আপনার বিয়ের ১০ বছর এবং সন্তানের বয়স সাত বছর। তার মানে, বিয়ের তিন বছরের মধ্যেই মাতৃত্ব ও অভিভাবকত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এসে পড়ে আপনার জীবনে। এই সময়গুলোয় স্বামীর অনুপস্থিতিতে জীবন চালিয়ে নেওয়া কঠিন। এরই মধ্যে নিজের পড়ালেখাও চালিয়ে গেছেন। এতে বোঝা যায়, আপনি একজন সচেতন ও পরিশ্রমী মানুষ।
দীর্ঘ সময় ধরে স্বামীর শারীরিক অনুপস্থিতি ও নানা ধরনের দায়িত্ব হয়তো আপনাকে মানসিকভাবে ক্লান্ত ও একা করে তুলেছিল। এ অবস্থায় কাছের কোনো মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা ও যত্ন অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে ওঠে। যে সময়ে ও যেভাবে আপনার স্বামী আপনার বন্ধু ও ভরসাস্থল হওয়ার কথা ছিল, সে সময়ে ও সেভাবে আপনার স্বামীর অনুপস্থিতির কারণে দেবরের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভরসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মানুষ প্রয়োজনের সময় প্রতিনিয়ত যার সাড়া, সান্নিধ্য ও সহযোগিতা পায়, তার প্রতিই আবেগপ্রবণ হয়ে নির্ভর করতে শুরু করে। এটি খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়।
আবেগ–অনুভূতির মধ্যে ভুল বলে কিছু নেই। তবে এই অনুভূতিকে আপনি কোন দিকে প্রবাহিত করবেন, কীভাবে আচরণ করবেন, আপনার সম্পর্কগুলোকে কীভাবে পরিচালনা করবেন, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিজেই বলেছেন, এখনো দেবরের সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্কে আপনি জড়াননি, যা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য; বরং দুজনই নিজেকে সামলে চলেছেন। এটাই আপনার সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিচায়ক।
দেবর ও ভাবির মধ্যে যেহেতু একটি পারিবারিক সম্পর্ক আছে, এখানে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও ভরসা থাকতেই পারে। সেই সঙ্গে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে মনোযোগ দিন। আপনার স্বামীরও এখানে দুটি ভূমিকা রয়েছে—১. তিনি আপনার জীবনসঙ্গী, ২. তিনি আপনার সন্তানের বাবা। এই দুটি ভূমিকায় থাকা একজন মানুষের যে দায়িত্বগুলো আছে, তিনি যেন তা যথাযথভাবে পালন করেন, সেটা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। একই সঙ্গে আপনাদের মধ্যে যেন যথেষ্ট বন্ধুত্ব ও অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়, সে ব্যাপারে খোলামেলাভাবে আপনার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। দূরে না থেকে সম্ভব হলে একসঙ্গে থাকার চেষ্টা করুন, যেন তাঁর অনুপস্থিতি আপনার একাকিত্বের কারণ না হয়। এটি সম্ভব না হলে নিজেদের মধ্যে নিয়মিত কথা বলে, দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে মানসিকভাবে পরস্পরের কাছে আসার চেষ্টা করুন।
সবশেষে বলব, আমাদের অনুভূতিগুলো ব্যক্তিগত, কিন্তু আচরণ ও সিদ্ধান্ত ব্যক্তি ছাড়াও পরিবার ও সমাজকে প্রভাবিত করে। তাই কোনো আচরণ করা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় তার নৈতিক ও মানবিক দিকগুলো বিবেচনা করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এখন পর্যন্ত যেভাবে নিজেকে সামলে রেখেছেন ও পরিচালনা করছেন, তাতে বোঝা যায়, সেসব বিবেচনা করেই পথ চলছেন। আপনার জন্য শুভকামনা রইল, কঠিন সময়টুকু কাটিয়ে উঠুন।
পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: adhuna@prothomalo.com (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা : প্র অধুনা, প্রথম আলো, প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবন, ২০–২১ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA