অকারণে খারাপ ব্যবহার করেন অনেকে
অকারণে খারাপ ব্যবহার করেন অনেকে

অকারণে মানুষ আপনাকে আঘাত করে? এর পেছনেও থাকতে পারে এই ৪ কারণ

আপনাকে কোনো কারণ ছাড়াই অনেকে কষ্ট দেয়, অপমান করে, আঘাত করে। ঘটনা ঘটার সময় বা পরবর্তী সময়ে আপনি হয়তো ভাবতে বসেন, আমি কী ভুল করলাম? তবে যাঁরা আপনাকে অকারণে কষ্ট দেয়, তাঁদের এই আচরণের পেছনে অধিকাংশ সময় আপনার কোনো হাত থাকে না। বরং তাঁদের নিজের যন্ত্রণার প্রতিফলন হিসেবেই এমন আচরণ করেন। এই খারাপ ব্যবহারের পেছনে থাকতে পারে অনেক কারণ। তার মধ্য থেকে অন্যতম চারটি কারণ সম্পর্কে জেনে রাখুন।

আলো যত উজ্জ্বল, ছায়া তত গভীর।
কার্ল ইয়ুং (১৮৭৫-১৯৬১), সুইস মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসক

১. মনের ভেতরের ছায়া

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে এমন একটি অংশ আছে, যেখানে লুকিয়ে থাকে রাগ, ভয়, লজ্জা, হিংসা আর অনিরাপত্তা। কেউ কেউ এই অংশকে বোঝেন, মেনে নেন। আবার কেউ ভেতরেই চেপে রাখেন। আর সেই দমন করা আবেগ একসময় ফেটে পড়ে অন্যের প্রতি নেতিবাচক আচরণ হিসেবে।

কার্ল ইয়ুং এ প্রক্রিয়াকে বলেছিলেন ‘প্রজেকশন’। বাংলায় বললে অভিক্ষেপ। মানে নিজের ভেতরের কষ্ট বা দুর্বলতাকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেন অনেকেই। যেমন কেউ নিজের অযোগ্যতা মেনে নিতে না পেরে আরেকজনকে দুর্বল হিসেবে চালিয়ে দেন। এভাবে তিনি নিজের কষ্ট থেকে বাঁচতে চান। কিন্তু এতে বাস্তব চিত্রটা অকৃত্রিম থাকে না, সম্পর্ক ভাঙে আর অকারণ সংঘাত তৈরি হয়।

এই ধারণা বুঝতে পারলে উপলব্ধি করতে পারবেন, যিনি আঘাতটা করলেন, তিনি আদতে তাঁর সমস্যারই বহিঃপ্রকাশ করলেন। তখন আমরা প্রতিশোধ নয়, সহমর্মিতা বেছে নিতে পারি।

দমন করা আবেগ একসময় ফেটে পড়ে অন্যের প্রতি নেতিবাচক আচরণ হিসেবে

১৯৯৭ সালে ‘জার্নাল অব পারসোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলোজি’ নামের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা নিজেদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাঁরা প্রায়ই অন্যদের শত্রু মনে করেন। এর মধ্য দিয়ে যেন নিজেদের রাগ বা কষ্টের একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পান বা খোঁজার চেষ্টা করেন।

২. হিংসা ও ঈর্ষা

হিংসা ও ঈর্ষা এমন অনুভূতি, যা কেউ সহজে স্বীকার করে না। ঈর্ষা মানে যেটা আছে, সেটা হারানোর ভয়; আর হিংসা মানে যা নেই, সেটা অন্যের আছে দেখলে কষ্ট পাওয়া। কেউ যখন প্রতিকূলতার মধ্যেও হাসেন, ইতিবাচক ব্যবহার করেন, তখন অনেকেই সেটা মেনে নিতে পারেন না। তাঁরা তখন ওই ব্যক্তির সমালোচনা করেন, ছোট করেন, আঘাত করেন।

কিন্তু আদতে এমন ব্যক্তিরা আপনার সঙ্গে নয়, নিজেদের অসম্পূর্ণতার সঙ্গে লড়ছেন। হিংসা থেকে জন্ম নিতে পারে ‘শাডেনফ্রয়ডা’। অর্থাৎ পরের দুর্দশায় আনন্দ পাওয়া। এ জন্যই কেউ কেউ অন্যকে কষ্ট দিয়ে তৃপ্তি পান। বিশেষ করে যাঁদের দেখে তাঁরা নিজেকে ছোট মনে করেন।

যাঁরা নিজেরা আঘাতপ্রাপ্ত, তাঁরাই আবার অন্যকে আঘাত করেন

৩. আঘাত

ইংরেজিতে বলা হয়, ‘হার্ট পিপল হার্ট পিপল’। অর্থাৎ যাঁরা নিজেরা আঘাতপ্রাপ্ত, তাঁরাই আবার অন্যকে আঘাত করেন। শৈশবের ট্রমা, অবহেলা, ভালোবাসার অভাব—এসব একজন ব্যক্তির ভেতরকে বিকৃত করে দিতে পারে। অবশ্য সবার বেলায় এমনটা ঘটে না। কেউ কেউ নিজের জীবনের কষ্টকে ভালোবাসা ও সহমর্মিতায় রূপান্তর করে ফেলেন, আবার কেউ রাগ ও সহিংসতায়।

২০০৩ সালের এক গবেষণা বলছে, ট্রমা মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোকে প্রভাবিত করে, যা সিদ্ধান্ত নেওয়া ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যুক্ত। এর ফলে কেউ হয়তো খুব দ্রুত রেগে যায়, অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারে না। শৈশবের নির্যাতন মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তন করতে পারে, যা জীবনের পরবর্তী সময়ে আচরণগত সমস্যার কারণ হয়।

৪. ক্ষমতা

অনেকে আছেন অন্যের মনে আঘাত দেন এবং তা অনুভবও করেন না।

সব নিষ্ঠুরতার পেছনে ট্রমা বা হিংসা কাজ করে না। অনেকে অন্যকে আঘাত করে শুধু ক্ষমতা দেখানোর জন্য। আপনি হয়তো ‘না’ বলেছেন, নিজের মর্যাদা ধরে রেখেছেন, স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছেন—এটাই অনেকের কাছে হুমকি বা সমস্যা মনে হয়। তখন তাঁরা চেষ্টা করে আপনাকে দমিয়ে রাখতে, ভেঙে দিতে, যেন নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে না হয়।

মার্কিন মনোবিজ্ঞানী মার্থা স্টাউট তাঁর ‘দ্য সোশিওপ্যাথ নেক্সট ডোর’ বইয়ে লিখেছেন, প্রতি ২৫ জনে এমন একজন থাকেন, যাঁর বিবেকবোধ ভোঁতা। তাঁরা অন্যের মনে আঘাত দেন এবং তা অনুভবও করেন না।

অন্যের আচরণের কারণ জানলেও হয়তো মন খারাপ বা কষ্ট কমবে না। তবে মানসিকভাবে আপনি কিছুটা নির্ভার বোধ করবেন। তখন আর এই প্রশ্ন কষ্ট দেবে না, ‘আমি কী ভুল করলাম?’


সূত্র: মিডিয়াম