নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি যাত্রা শুরু করা ট্রপিক্যাল হোমস আবাসনপ্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম। গত নভেম্বরে সফল এই উদ্যোক্তার মৃত্যুর পর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তাঁর ছেলে তানভীর রেজা। এর আগে ছয় বছর ভাইস চেয়ারম্যানের পদেও ছিলেন। গত ১১ মে নিজের কার্যালয়ে কোম্পানির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বর্ণিল বসত–এর সঙ্গে কথা বলেছেন ট্রপিক্যাল হোমসের চেয়ারম্যান তানভীর রেজা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার
আপনার বাবা রেজাউল করিম ট্রপিক্যাল হোমসের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। আপনি যখন বেড়ে উঠেছেন, তখন ট্রপিক্যাল হোমসও বড় হয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানের হাল ধরলেন আপনি। এই পথচলা কেমন ছিল?
তানভীর রেজা: নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন ট্রপিক্যাল হোমসের যাত্রা শুরু, তখন আমি নিতান্তই বালক। আমি ক্লাস নাইন–টেনের ছাত্র। এই ব্যবসার আগে বাবাদের একটা ছোটখাটো কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ছিল। সেখানেও তাঁরা সফল হয়েছিলেন। একটা পর্যায়ে এসে বাবার মনে হয়েছে, এখন আবাসনশিল্পে বিনিয়োগের সময় এসেছে। আবাসন ব্যবসা শুরুর পর দেখতাম, বাবা সকালবেলা বাসা থেকে বের হতেন। সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করে রাতের বেলা বাসায় আসতেন। কোনো কোনো দিন টেনশনে রাতে ঘুমাতেন না বাবা। তখন আমার মনে হতো, ‘বাবা এ মুহূর্তে সিরিয়াস কিছু নিয়ে কাজ করছেন। বাবার ওপর দিয়ে অনেক চাপ যাচ্ছে।’ আমার বাবা অত্যন্ত দায়িত্ববান ও সৃজনশীল মানুষ ছিলেন। তিনি কবিতা লিখতেন। আবৃত্তি করতেন। গান ভালোবাসতেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে চলাফেরায় পছন্দ করতেন। তবে মানুষ হিসেবে বাবা খুবই শক্তিশালী মানসিকতার ছিলেন। তিনি পৃথিবীর কোনো সমস্যাকে সমস্যা মনে করতেন না। সমস্যা কিংবা চ্যালেঞ্জ শব্দগুলো তাঁর পছন্দ ছিল না। তিনি বলতেন, কাজ করবা…সমস্যা আসবে, সমাধান করবা।
ট্রপিক্যাল হোমসের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হলেন…
তানভীর রেজা: ট্রপিক্যাল হোমস যখন এক দশক পূর্ণ করে, তখন আমি পরিণত যুবক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (ইইই) স্নাতক পাস করেছি। ওই সময়ে আমি খুব সহজেই কোম্পানিতে যোগ দিতে পারতাম। তবে বাবা বললেন, আমি যে স্ট্রাগল করে ব্যবসাটা চালাচ্ছি, সেটি বোঝার জন্য তোমাকে যোগ্য হয়ে আসতে হবে। তখন আমি বললাম, দেশে তো অভিজ্ঞতা নিতেই পারব। তার আগে বিদেশে পড়াশোনা করে আসি। বাবা সায় দিলেন। মাস্টার্স করতে অস্ট্রেলিয়া চলে গেলাম। তখন বাবার সঙ্গে প্রায়ই কথা হতো। তিনি বলতেন, ব্যবসায় কী হচ্ছে, না হচ্ছে। যখনই দেশে ছুটিতে আসতাম, আমাকে কোম্পানিতে কাজ শেখাতেন বাবা। তো মাস্টার্স শেষ করার পর অস্ট্রেলিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম বিমা কোম্পানিতে চাকরি হলো। চাকরি শুরু করলাম। সেখানকার জীবনযাত্রায় থিতু হয়ে গেলাম অনেকটা। তবে আমি জানতাম, আমাকে দেশে ফিরতে হবে। ধীরে ধীরে মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। আমি বাবার একমাত্র ছেলে। আমার দুই বোন আছেন। তবে তাঁরা ব্যবসায় যুক্ত নন। ২০১৮ সালে পাকাপাকিভাবে দেশে চলে আসি। ট্রপিক্যাল হোমসে যোগ দিই। বিদেশ থেকে আসার সময় অনেকেই বলেছেন, দেশে যাচ্ছিস যা, ছয় মাসের বেশি টিকতে পারবি না। সৌভাগ্যবশত আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। তবে আমাকে প্রায় দুই বছর স্ট্রাগল করতে হয়েছে। এ সময় বাবা আমার পাশে ছিলেন।
তাহলে ট্রপিক্যাল হোমসে বাবার সঙ্গে সরাসরি ছয় বছর কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। আপনি বাবার কোন বিষয়গুলো অনুসরণ করেন?
তানভীর রেজা: আমাদের প্রতিষ্ঠানে আমরা একটা বিষয় সব সময় মেনে চলি। এটিকে আমরা বলি ‘ওপেন ডোর পলিসি’। অর্থাৎ আমি প্রতিষ্ঠানের ওপরের স্তরে উঠে গেছি, সে জন্য আমার কাছে আসার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগবে, এটি আমরা কখনোই সমর্থন করি না। আমার বাবা বলতেন, ‘তুমি যদি মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারো, তাহলে তোমার ব্যবসা করার দরকার নেই। যদি কোনো গ্রাহকের কোনো বিষয়ে অভিযোগ থাকে এবং তিনি যদি তোমার কাছে পৌঁছাতে না পারেন, তাহলে তুমি ঠিকঠাকভাবে কাজটা করতে পারছ না।’ প্রত্যেকটা মানুষের কাছে অ্যাকসেস থাকতে হবে। বিদেশে এই জিনিস আছে। তবে বাংলাদেশে বেশির ভাগ কোম্পানিতে আসলে এটা পরিপালিত হয় না। যাহোক, সবার জন্যই অ্যাকসেসটা আমি নিশ্চিত করেছি। এটা আমার বাবার শেখানো। প্রকল্প বাছাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও ভালোভাবে রপ্ত করিয়েছেন বাবা। কোন প্রকল্পে যেতে হবে, কোনটিতে যাওয়া যাবে না, কার সঙ্গে ব্যবসা করা যাবে, কার সঙ্গে করা যাবে না—এসব বাবা শিখিয়েছেন। বাবা বলতেন, এসব করতে যদি তোমার দুইটা পয়সা কম লাভ হয়, কোনো অসুবিধা নেই। কখনো এমন প্রকল্পে যাবা না, যেখানে মুনাফা আকাশচুম্বী। তখন বুঝতে হবে, সেখানে কোনো না কোনো গন্ডগোল আছে।
মালিবাগে দেশের প্রথম ৪৫ তলা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছে ট্রপিক্যাল হোমস। সাহসী এই প্রকল্প নেওয়ার পেছনের গল্পটা কী?
তানভীর রেজা: এটি প্রায় আট বছরের দীর্ঘ যাত্রা। মালিবাগের নির্মাণাধীন এই টাওয়ারের জমির মালিকদের আরেকটি জমিতে (উত্তরায়) আমরা একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প করেছিলাম। ট্রপিক্যাল আলাউদ্দিন টাওয়ার। এই প্রকল্প যখন আমরা করেছি, তখন তাঁরা সন্তুষ্ট হয়েছেন। তাঁরা বুঝেছেন, আমরা কথা দিয়ে কথা রাখি। তাই ওনারা যখন চিন্তা করলেন, মালিবাগ সুপারমার্কেটের জায়গাটি ডেভেলপ করা যেতে পারে, তখন আমাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। এটি খুবই জটিল প্রক্রিয়া ছিল। কারণ, তিনতলা মার্কেটে শত শত দোকানদার ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে জমির মালিকদের একধরনের চুক্তি রয়েছে। একেক দোকানদারের কাগজ একেক দিকে আছে। ফলে তিন পক্ষের মধ্যে মতৈক্য আসতে বছরের পর বছর চলে যায়। তারপর আমরা যখন প্রকল্পের মূল পরিকল্পনা শুরু করলাম, তখন চিন্তা করলাম, এত সুন্দর জায়গায় ছোট ভবন করব না। একটা পর্যায়ে দেখা গেল, ভবনের চারদিকে নিয়ম অনুযায়ী জায়গা ছাড়ার পর আমরা যে কয়টা তলা পাচ্ছি, তা দিয়ে নির্মাণের খরচ ওঠানো সম্ভব নয়। তখন আমরা আবার জমির মালিকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম। আমরা চিন্তা করলাম, ৩৫ তলা ভবন করার যে খরচ ও পরিশ্রম হবে, আরেকটু কষ্ট করলে আরও ১০ তলা হয়ে যাবে। আমার বাবা খুবই দুঃসাহসিক মানসিকতার মানুষ ছিলেন। তিনি অনেক বড় প্রকল্প চোখ বন্ধ করে নিতে পারতেন। শেষ পর্যন্ত আমার বাবা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবিউল হক, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল হুদাসহ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই স্বপ্নের প্রকল্প নির্মাণের যাত্রা শুরু করি।
আপনার মতো দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে এসেছে দ্বিতীয় প্রজন্ম। আগামীর দিনগুলোয় আপনারা নিজেদের কোম্পানিকে কোন দিকে এগিয়ে নিতে চান?
তানভীর রেজা: দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের অনেকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় আছে। তাঁদের একটি বড় অংশ বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে দেশে এসেছেন। অনেকে আবার বিদেশে রয়ে গেছেন। আমি মনে করি, দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের চিন্তাভাবনার জায়গাটা কাছাকাছি। সেটা হচ্ছে, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোম্পানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করা। এ ছাড়া ব্যবসায়ে বৈচিত্র্য আনার বিষয়েও আমরা কাজ করছি। আসলে আমরা আমাদের ব্যবসার পাশাপাশি নতুন সুযোগও খুঁজতে চাই।
বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ খুবই জটিল। যেমন আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে দু–তিন বছর ধরে ড্যাপ নিয়ে ভুগছেন আপনি। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আপনাদের চাওয়া কী?
তানভীর রেজা: সিম্পল। সেটা হচ্ছে, সরকার যে নিয়মকানুনই করুক না কেন, তা যেন সবার জন্য সমান হয়। আপনি যখন ড্যাপ করছেন, তখন ঢাকাবাসীর সুযোগ–সুবিধা আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। এমনকি আবাসন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সুবিধা–অসুবিধাও দেখতে হবে। ঢাকা শহরকে গড়ে তোলার পেছনে বেসরকারি আবাসন কোম্পানিগুলোর অনেক অবদান রয়েছে। ভবিষ্যতের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বের বড় বড় শহর এভাবেই গড়ে ওঠে। কাজেই সরকার এমন কোনো নীতিমালা না করুক, যাতে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করুক, যাতে শহরের পরিবেশ ঠিক থাকে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
তানভীর রেজা: আপনাকেও ধন্যবাদ।