চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়া ছিল জীবনের বড় ‘টার্নিং পয়েন্ট’
এশিয়ার ৩০ বছরের কম বয়সী উদ্যোক্তা ও সমাজ পরিবর্তনকারীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস। সেখানে জায়গা করে নেওয়া বাংলাদেশি সাত তরুণের একজন দীপ্ত সাহা। দীপ্তদের প্রতিষ্ঠান অ্যাগ্রোশিফট এর মধ্যে এইচঅ্যান্ডএম ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘স্টিচ ফর আরএমজি গ্লোবাল ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ’-এও বিজয়ী হয়েছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কৃষক ও শ্রমিকদের যুক্ত করার ভাবনা কীভাবে মাথায় এল? কেনই–বা নয়টা-পাঁচটা চাকরি ছেড়ে এই উদ্যোগ নিলেন দীপ্ত? সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারজানা লিয়াকত
আপনি ‘ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়া’র একজন হয়েছেন। অভিনন্দন! কীভাবে এত দূর পৌঁছলেন?
২০২২ সালে আরও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাগ্রোশিফট নামে একটি উদ্যোগ শুরু করি। আমাদের লক্ষ্যই হলো দেশের দুই অবহেলিত অথচ গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায় কৃষক ও শ্রমিককে যুক্ত করা। ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে আমরা শ্রমিকদের সুলভে দৈনন্দিন কৃষিপণ্য পৌঁছে দিচ্ছি, পাশাপাশি কৃষকদেরও একটা বড় বাজার ধরতে সাহায্য করছি। ফলে, দুই পক্ষই লাভবান হচ্ছে। ফোর্বস এই প্রচেষ্টাকেই সাধুবাদ জানিয়েছে।
অ্যাগ্রোশিফটের কাজটা আরেকটু বিস্তারিত বলবেন?
অ্যাগ্রোশিফট মূলত একটি অ্যাগ্রিটেক (প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি) প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে দৈনন্দিন পণ্যের একটা ডিজিটাল বাজার গড়ে তুলেছি আমরা। প্রাথমিকভাবে আমাদের গ্রাহক কারখানার শ্রমিক (মূলত পোশাকশ্রমিক)। অ্যাগ্রোশিফটের মাধ্যমে গ্রাহকেরা তাঁদের কারখানার ভেতরেই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে চাহিদা জানিয়ে দিতে পারেন। লেনদেনও সেখানেই হয়। ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পৌঁছে দিই আমরা। শ্রমিকদের বিপুল চাহিদা অনুযায়ী জোগান দিতে আমরা একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছি। এই নেটওয়ার্কে কৃষক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও প্রস্তুতকারকেরাও আছেন। সরবরাহব্যবস্থাটা কার্যকর বলেই এখানে মালামাল নষ্ট হয় কম, একই সঙ্গে গ্রাহকও বাজারমূল্যের তুলনায় অনেক কম দামে পণ্য পেয়ে যান।
ছিলেন নয়টা-পাঁচটা চাকরি করা একজন প্রকৌশলী। চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা কেন ভাবলেন?
এটা ঠিক যে নয়টা-পাঁচটা চাকরি করা প্রকৌশলী ছিলাম, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে কেন যেন মনে হতো, প্রকৌশলটা ঠিক আমার জায়গা নয়। যদিও মনেপ্রাণে বুয়েটেই পড়তে চেয়েছি, কিন্তু প্রকৌশল আমাকে টানেনি। এমন নয় যে হঠাৎ কোনো এক বিশেষ মুহূর্তে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভেবেছি; বরং এটা একধরনের উপলব্ধি বলতে পারেন। ধীরে ধীরে উপলব্ধিটা হয়েছে বলেই উদ্যোক্তা হওয়ার পথে পা বাড়ানো সহজ হয়েছে। তবে শুরুর দিকে একটা বড় বাধা ছিল বিনিয়োগ। নিজে চলার মতো যথেষ্ট উপার্জনই আমার ছিল না। তাই প্রকৌশলী হিসেবে চাকরিটা নিয়েছিলাম। সেই চাকরিও অবশ্য তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ছয় মাস চাকরি করে টাকা জমিয়েছি।
যখন মনে হয়েছে, উদ্যোগ শুরু করার মতো যথেষ্ট টাকা হাতে এসেছে, তখন আর দেরি করিনি। শুরুতে খামার-ই নামে একটা উদ্যোগ নিই, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে দুগ্ধখামারিদের সাহায্য করা। তত দিনে কৃষক ও পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আমার হয়ে গেছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েই ২০২২ সালে কাজী বুলান্দ মুসাব্বির ও রামিজ হককে সঙ্গে নিয়ে শুরু করি অ্যাগ্রোশিফট। দ্বিতীয় উদ্যোগটা যখন সফল হতে শুরু করল, তখন আর পেছনে তাকাইনি। চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর উদ্যোক্তা হয়ে যাওয়াটা আমার জীবনের বড় ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছিলাম বলেই আজ আমার আগ্রহটাকে কাজে লাগাচ্ছি, স্বপ্নের পেছনে ছুটতে পারছি, নিজের একটা লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছি।
Also Read: তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়েই আমাদের কাজ
বাংলাদেশে একজন উদ্যোক্তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
আমি মনে করি, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুটি। প্রথমত, প্রচলিত ধ্যানধারণা। দ্বিতীয়ত ভয়। অকল্পনীয় কিছু অর্জনের পেছনে ছুটতে আমরা ভয় পাই। দেশের শিক্ষাপদ্ধতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতিই আমাদের চিন্তার জগৎকে সংকীর্ণ করে দেয়, উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করে। এমন গন্তব্যই আমরা ঠিক করি, যেখানে সহজে পৌঁছানো যায়। এই বাধাগুলো পেরোনোই বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এখন পর্যন্ত আপনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন কী?
সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে—এমন একটা উদ্যোগের পেছনে নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছি, এটাই তো বড় অর্জন। এই অর্জন কিন্তু রাতারাতি আসেনি। একটু একটু করে এগোতে হয়েছে। উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রায় অনেক সময় মনে হয়েছে, লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। যখন দেখেছি, মানুষ তার আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আমাদের প্ল্যাটফর্মে খরচ করছে, একই সঙ্গে সঞ্চয় করতেও সক্ষম হচ্ছে, তখন মনে হয়েছে, এটা একটা বড় অর্জন। একজন পোশাকশ্রমিক যদি তাঁর বেতনের ৫ শতাংশও সঞ্চয় করতে পারেন, সেটাও কিন্তু তাঁর পরিবারের পুষ্টি কিংবা সন্তানদের শিক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে। আমার কাজ অনেক মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলছে, তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে, এটা দেখার একটা আনন্দ আছে। এর চেয়ে বড় অর্জন আর হয় না।
আরও পড়ুন
-
মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে এশিয়ায় বেশি পিছিয়ে বাংলাদেশের নারীরা
-
পৃথিবীর কোন দেশে সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকতে পারছে অবাধে: ওবায়দুল কাদের
-
পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদীশাসনে হাজার কোটি টাকা বাড়তি চায় চীনা ঠিকাদার
-
বিশ্বের সেরা এয়ারলাইনস আট মাসের বেতনের সমান বোনাস দিচ্ছে
-
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সিরিজের ভেন্যুতে ঝড় বয়ে গেছে