
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী রবার্ট কিয়োসাকির বেস্টসেলার বই ‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড’ ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হলেও এটি এখন পর্যন্ত পারসোনাল ফাইন্যান্সের অন্যতম প্রভাবশালী গাইড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ২৮ বছর পরও আমরা ‘ধনী বনাম গরিব মানসিকতা’ উদাহরণ টানতে এই বইয়ের রেফারেন্সই ব্যবহার করি।
কিয়োসাকি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের এক উচ্চশিক্ষিত বাবার ঘরে জন্ম নেন, যাঁকে তিনি ‘পুওর ড্যাড’ বলেন। এই পুওর ড্যাড মেধাবী ও পরিশ্রমী হলেও চাকরি-বেতন-বিলের চক্রে বন্দী ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর বন্ধুর বাবা ‘রিচ ড্যাড’ ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। তিনি ছোটবেলা থেকেই কিয়োসাকিকে শেখাতেন, টাকা কীভাবে কাজ করে, ঝুঁকি কোথায় এবং কোন জিনিসকে সম্পদ বলা যায়।
আজও কিয়োসাকির মূল শিক্ষা একটাই—টাকা রোজগার মানে শুধু বেশি আয় নয়; বরং সঠিকভাবে ভাবা, শেখা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। চলুন দেখি কিয়োসাকির বাস্তবসম্মত ও প্রাসঙ্গিক ছয়টি কৌশল।
‘রিচ ড্যাড পুওর ড্যাড’ বইতে কিয়োসাকি বলেন, ‘সম্পদ হলো সেই জিনিস, যা আপনার পকেটে টাকা আনে, আর দায় হলো সেই জিনিস, যা আপনার পকেট থেকে টাকা বের করে দেয়।’
এই এক বাক্যই আমাদের খরচের ধারণা পুরোপুরি বদলে দিতে পারে। আমরা অনেকেই নতুন গাড়ি, সর্বশেষ সংস্করণের ফোন বা দামি বাড়ি কিনে গর্ব করি। কিন্তু এগুলো কিনতে হয়তো ঋণ নিতে হবে বা জমা করা টাকা খরচ করতে হবে। ফলে ঋণের কিস্তি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জীবনযাপনের খরচের চক্রে পড়ে যেতে পারেন।
এগুলো শেষ পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে সীমিত করে। কিয়োসাকি বলেন, ধনীরা আগে সম্পদ কেনেন, যেমন আয়মূলক ব্যবসা গড়ে তোলা, বিনিয়োগ করা (শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, সোনা ও বন্ডে), ভাড়া থেকে নিয়মিত আয় হয়—এমন রিয়েল এস্টেট।
রিয়েল এস্টেট বলতে বোঝায় মনের চিন্তা, জ্ঞান বা সৃজনশীলতা থেকে তৈরি এমন সম্পদ, যেগুলো থেকে নিয়মিত আয় করা যায়, যেমন বই লেখা, অনলাইন কোর্স বিক্রি করা, অনলাইন কনটেন্ট তৈরি করা বা পেটেন্ট থেকে রয়্যালটি পাওয়া।
এসব উৎস থেকে আয় নিশ্চিত করার পরই তাঁরা গাড়ি, বাড়ি বা অন্যান্য বিলাসী জিনিস কেনার কথা ভাবেন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ‘জীবন শুরু মানেই নিজের বাড়ি’—এই প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আগে বাস্তব আর্থিক নিরাপত্তা গড়ে তুলুন, তারপর বড় দায় নিন।
কিয়োসাকির একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘আয়ের জন্য নয়, শেখার জন্য কাজ করো।’ এর অর্থ হলো, চাকরি মূলত মাসের বিল পরিশোধ করে; কিন্তু দক্ষতা আপনাকে দীর্ঘ মেয়াদে সম্পদ গড়ার সক্ষমতা দেয়।
তাই তিনি পরামর্শ দেন নিয়মিত নতুন নতুন দক্ষতা শেখার, যেমন সেলস ও মার্কেটিং, যোগাযোগদক্ষতা, বিনিয়োগ জ্ঞান, টাকার ব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোক্তা দক্ষতা।
দক্ষতা যত বাড়ে, আয়ের সুযোগও তত বিস্তৃত হয়। কিয়োসাকির নিজের জীবনই এর প্রমাণ। তিনি মেরিন কর্পসে সেবা দিয়ে চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন, পরে জেরক্সে সেলসের কাজ করে বাস্তব দক্ষতা অর্জন করেন।
এই শেখাই পরে তাঁকে সফল ব্যবসা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। তাঁর যাত্রা আমাদের একটাই কথা মনে করিয়ে দেয়—আপনি কোথা থেকে শুরু করলেন, তা নয়; বরং শেখার আগ্রহ আর দক্ষতা অর্জনের মানসিকতাই আপনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
কিয়োসাকির সবচেয়ে আলোচিত বক্তব্যগুলোর একটি হলো—দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষ সাধারণত টাকা হারানোর ভয় পায়। কিন্তু ধনীরা ভয় পায় অর্থ সম্পর্কে না জানাকে। তাঁর মতে, সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো একেবারেই কোনো ঝুঁকি না নেওয়া।
তবে এর অর্থ বেপরোয়া হওয়া নয়; বরং শেখা, গবেষণা করা এবং প্রস্তুত থাকা। এ কারণেই তিনি পরামর্শ দেন—বিনিয়োগের আগে শেয়ারবাজার ভালোভাবে শিখে নিন। জমি বা ফ্ল্যাট কেনার আগে সংশ্লিষ্ট আইনকানুন জেনে নিন।
ব্যবসা শুরু করার আগে ব্যবসার আদ্যোপান্ত বুঝে নিন। সম্পদ বাড়াতে হলে আপনাকে স্বস্তির জায়গা থেকে বাইরে বের হতে হবে। তবে তার আগে নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
ছোটবেলায় আমাদের বলা হতো, ‘যদি তুমি ভালো করে পড়ালেখা করো, তাহলে তুমি একটি ভালো চাকরি পাবে।’ কিন্তু কিয়োসাকি বলেছেন এর ঠিক উল্টোটা, ‘গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষ টাকা রোজগারের জন্য কাজ করে, আর ধনীরা টাকাকেই তাদের জন্য কাজ করায়।’
এর অর্থ হলো, আপনার আয় শুধু আপনার সময় বা শারীরিক উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। আপনাকে এমন সম্পদ তৈরি করতে হবে, যা আপনি কাজ না করলেও আয় এনে দেবে, এমনকি ঘুমের মধ্যেও।
যেমন স্টক থেকে ডিভিডেন্ড পাওয়া, সাইড ব্যবসার মাধ্যমে বাড়তি আয় করা, বাড়িভাড়া থেকে নিয়মিত আয় নিশ্চিত করা, কনটেন্ট বা বই থেকে রয়্যালটি পাওয়ার ব্যবস্থা করা কিংবা অনলাইন অটোমেটেড ইনকামের উৎস তৈরি করা।
কিয়োসাকির মতে, সম্পদ গড়ে ওঠে প্রথমে মানুষের মানসিকতায়; টাকা আসে তার পর। আপনি হয়তো লক্ষ করেছেন, একই পরিমাণ আয় থাকলেও কেউ ধীরে ধীরে সম্পদ গড়ে তোলেন আর কেউ মাসের শেষ দিকে টানাটানিতে পড়ে। এখানে টাকাটা পার্থক্য তৈরি করে না; বরং মানুষের চিন্তাধারাটাই পার্থক্য গড়ে দেয়।
সীমাবদ্ধতার চেয়ে তাঁরা সুযোগকে বড় করে দেখেন।
তাৎক্ষণিক বা ক্ষণস্থায়ী আনন্দের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি লাভকে বেশি গুরুত্ব দেন।
ভয়ের পরিবর্তে তাঁরা প্রাচুর্যের চিন্তা করেন।
ভাগ্যের ওপর নয়, কৌশলের ওপরই তাঁরা বেশি ভরসা রাখেন।
এ মানসিকতাই খরচ থেকে শুরু করে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ক্যারিয়ার—জীবনের সব আর্থিক সিদ্ধান্তের ধরন পাল্টে দেয়।
আজকের দিনে কিয়োসাকির কথাগুলো আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ, আর্থিক স্বাধীনতা এখন বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন। আপনাকে উদ্যোক্তা হয়ে জন্ম নিতে হবে না; শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস শিখতে হবে, সঠিক অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে এবং মানসিকতা শক্তিশালী করতে হবে। শেষে কিয়োসাকির একটি কথা মনে রাখা জরুরি—আপনি তখনই দরিদ্র, যখন হাল ছেড়ে দেন।
সূত্র: এমএসএন