কোরবানির হাটে চুয়াডাঙ্গার গরুর আলাদা কদর আছে। প্রতি কোরবানির ঈদেই গণমাধ্যমের খবর হয় এই অঞ্চলের বিশাল বিশাল গরু। আলমডাঙ্গার ইকতার উদ্দিন মোল্লাকে এসব খবর অনুপ্রাণিত করত। চাকরির পিছে না ছুটে তাই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন ব্যবস্থাপনার এই স্নাতক। স্কুলশিক্ষক স্ত্রী শাহিনা আক্তারকে খামার করার ভাবনা জানালে তিনিও পাশে দাঁড়ান। শাহিওয়াল জাতের আটটি গরু নিয়ে শুরু হয় ইকতার-শাহিনার খামার। পরে আরও দুটি গরু যোগ হয়। এরই মধ্যে তাঁদের ঘর আলো করে আসে প্রথম সন্তান। মেয়ের নামে খামারের নাম রাখেন ‘তারিবা অ্যাগ্রো’।
খামারের অবকাঠামো নির্মাণ ও গরু কেনা বাবদ ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ হয়ে যায়। প্রতিদিন গরুর খাবারসহ পরিচর্যার খরচ তো আছেই। গরুর গরম লাগলে কয়টি ফ্যান ঘোরাতে হবে, মলমূত্র ত্যাগের পর কীভাবে সেসব দ্রুত পরিষ্কার করতে হবে, মশার কামড় থেকে গরুকে কীভাবে রক্ষা করতে হবে—ধীরে ধীরে সামনে আসে এমন অনেক বিষয়। সন্তানের মতোই গরুগুলোকেও লালন-পালন করতে থাকেন ইকতার।
২০১৭ সালে কোরবানির ঈদের মাসখানেক আগে থেকেই দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসতে থাকেন। আকার অনুযায়ী একেকটি গরুর দাম আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা হাঁকেন পাইকারেরা। ঢাকার পশুর হাটে গরু নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছেন, এমন কয়েকজন ইকতারকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রির পরামর্শ দেন। ঢাকায় গেলে যদি বাড়তি লাভ হয়, তাহলে সেটাই কি করা উচিত নয়?
ট্রাক ভাড়া করে গরু নিয়ে ঢাকায় যান ইকতার। কয়েক দিন কেটে যায়। ক্রেতাদের মধ্যে তেমন আগ্রহ দেখতে পান না। কেউ কেউ এমন দাম বলেন যে হতাশা জেঁকে বসে। ট্রাকভাড়া, নিজের ও দালালের থাকা-খাওয়ার খরচ মিলিয়ে প্রতিদিন খরচের অঙ্ক বাড়তেই থাকে।
খামারে যে গরু তিন লাখ টাকায় নিতে জোরাজুরি করছিলেন ক্রেতারা, এখানে তার দাম কেউ অর্ধেকও বলছিলেন না। ঈদের ঠিক আগের দিন ছয়টি গরু প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। বাকি চারটি গরু নিয়ে হতাশ হয়ে গ্রামে ফিরে আসেন।
২০১৮ সালেও ঈদের আগে দ্বিতীয়বারের মতো গরু নিয়ে ঢাকায় যান ইকতার। আগের বছরের মতোই ক্রেতার অভাবে ২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় দুটি গরু বিক্রি করেন আর দুটি বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন। দুই বছর পালনের পর ছয় লাখ টাকায় সেই দুটি বিক্রি করেন। তবে ঢাকায় নয়, নিজের খামারে।
ইকতার বলেন, ‘গরুর কাঙ্ক্ষিত দর না পাওয়ায় টানা চার বছরে বড় ক্ষতির মুখে পড়ি। পুঁজি হারিয়ে অনেকটাই নিঃস্ব হয়ে পড়ি।’
শাহিনা সাহস জোগান। নতুন করে আবারও খামার ব্যবস্থাপনায় হাত দেন ইকতার। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটি এঁড়ে, একটি বকনা আর এক জোড়া শাহিওয়াল জাতের গাভি কেনেন। এঁড়ে বাছুরটি ষাঁড়ে পরিণত হয়। বকনাটি বড় হয়ে আরও দুটি বকনা বাছুর জন্ম দেয় এবং গাভি দুটি আরও সাতটি বাছুর জন্ম দেয়, যার মধ্যে চারটি বর্তমানে ষাঁড়ে পরিণত হয়েছে এবং তিনটি বকনা এখন গাভিন।
শাহিনা আক্তার বলেন, ‘গাভি পালন আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়েছে। প্রতিবছর এখন লাভের মুখ দেখছি। চার বছরে দুটি গাভি থেকে আমরা প্রায় ২০ লাখ টাকা উপার্জন করেছি। পাশাপাশি মাঝারি আকারের কিছু ষাঁড় কিনে লালন–পালন করেছি। সব মিলিয়ে খামারে এখন ৯টি ষাঁড় আছে। ঢাকার একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ আটটি কিনতে চেয়েছে। আমরা দাম বলেছি ৮৫ লাখ। দরদামে কয়েক লাখ টাকায় বেঁধে আছে। তবে কাঙ্ক্ষিত দামেই বিক্রি করতে পারব আশা করি।’
কোরবানির উপযোগী ষাঁড় ছাড়াও তাঁদের খামারে ছয়টি গাভি, তিনটি বড় বকনা, পাঁচটি এঁড়ে ও একটি বাছুর আছে। শাহিওয়াল, ব্রাহমা ক্রস ও ফ্রিজিয়ান জাতের এসব গরুকে ঘিরে স্বপ্নের জাল বুনে চলেছেন ইকতার উদ্দিন মোল্লা ও শাহিনা আক্তার দম্পতি। ইকতার জানালেন, ঢাকার পশুর হাটে গরু নিয়ে গিয়ে আর ঠকতে চান না। খামার থেকে বিক্রির যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেটাই অব্যাহত রাখা হবে।