ডুয়ার্সের অন্দরে

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদারের লেখনীতে ডুয়ার্সের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা গেঁথে আছে আমাদের মতো যাঁরা এখন মাঝবয়সী, তাঁদের অনেকেরই মনে। তাই শিলিগুড়ি হয়ে সিকিম ভ্রমণের আগেই পরিকল্পনা করলাম দুই রাত ডুয়ার্সে থাকার। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে শিলিগুড়ি যাওয়া এখন অনেক সহজ। ঢাকা থেকে রাত ৯টায় বাস ধরে পরদিন সকাল ১০টা নাগাদ দুই পাশের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে দুপুর ১২টার মধ্যেই শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলাম।

ডুয়ার্সের নদীগুলো সজীব

দুপুরের খাওয়া সেরে ঢাকা থেকে টেলিফোনে ঠিক করে রাখা মতি ভাইয়ের গাড়ি নিয়ে সেবক রোড ধরে যাত্রা শুরু করলাম ডুয়ার্সের পথে। শিলিগুড়ি শহর পার হতেই দুই পাশে ঘন বন; মহানন্দা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য। কয়েক কিলোমিটার পরপর সাইনবোর্ডে সাবধানবাণী: হাতি পারাপারের করিডর। বুঝলাম, মাঝেমধ্যেই এখানে হাতির দেখা মেলে, যদিও আমরা দেখতে পাইনি। তবে সুউচ্চ গাছের সারি আর মাঝে চওড়া মসৃণ রাস্তা পরিবেশটাকেই অন্য রকম সুন্দর করে তুলেছে।

ঘণ্টাখানেক চলার পর আমরা করোনেশন ব্রিজে পৌঁছাই। তিস্তা নদীর ওপর ১৯৩৭ সালে রাজা ষষ্ঠ জর্জ ও রানি এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক স্মরণে এই ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৪১ সালে সম্পন্ন হয়। ব্রিজটি স্থানীয়ভাবে সেবক ব্রিজ বা বাঘপুল নামেও পরিচিত। তিস্তা নদীর গভীরতা ও স্রোতের কারণে এই ব্রিজ পিলার ছাড়াই ফিক্সড আর্চ বা খিলান ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। শীতকালে এই ব্রিজ থেকে দুই পাশে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে প্রবহমান নীল জলরাশির তিস্তা নদীর শোভা এককথায় অপরূপ।

পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীগুলোতে আছে প্রচুর পাথর

ডুয়ার্স শব্দের অর্থ দরজা। এই দরজা অতিক্রম করেই ভারতের সমতলভূমি থেকে ভুটানের পাহাড়ি অঞ্চলে যেতে হয়। প্রায় ৩০ কিলোমিটার চওড়া আর ৩৫০ কিলোমিটার লম্বা এই ডুয়ার্স, পূর্ব দিকে পূর্ব বা আসাম ডুয়ার্স আর পশ্চিম দিকে পশ্চিম বা বেঙ্গল ডুয়ার্স নাম বিভক্ত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ন্যূনতম ৩০০ ফুট ও প্রায় ৬ হাজার ফুট সর্বোচ্চ উচ্চতার এই অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মূর্তিসহ অনেক নদী বহমান। প্রচুর বৃষ্টিপাত ও ভূমির গঠনের জন্য এই অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ভরপুর—কয়েকটি বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য, অগণিত চা–বাগান ও জাতীয় উদ্যান এর অন্তর্ভুক্ত। বাঘ, হাতি, মহাবিপন্ন এক শিঙের গন্ডারসহ বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ ও পাখি এই বনাঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছে।

সেবক ব্রিজ হয়ে আমাদের গন্তব্য সিনক্লেয়ার্স রিট্রিট ডুয়ার্স, যা শিলিগুড়ি থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে চালসায় অবস্থিত। ব্রিজ থেকে চালসা পর্যন্ত পথের এক–চতুর্থাংশ জঙ্গলঘেরা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি এলাকা অতিক্রম করার পর বাকি অংশটুকু সমতলভূমির বনাঞ্চল, ফসলি জমি আর ছোট ছোট শহরের মধ্যে পিচঢালা চওড়া রাস্তা। চালসা শহরকে ডানে রেখে আরও উঁচুতে উঠে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের পরবর্তী দুই রাতের আবাস সিনক্লেয়ার্সের রিসোর্টে।

সিনক্লেয়ার্সের রিসোর্ট ভিউ

অন্যান্য সব রিসোর্টের মতো গেটে বুকিংয়ের কাগজপত্র দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে রিসেপশনে পাসপোর্ট এন্ট্রি করছিলাম, তখন ম্যানেজার সাহেব ওয়েলকাম ড্রিঙ্কস অফার করে সামনের লনে যেতে অনুরোধ করলেন। লনে গিয়ে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ—যত দূর চোখ যায়, শুধু বন আর মেঘের খেলা। জানালেন সামনের এই বনাঞ্চলই হাতির জন্য বিখ্যাত চাপড়ামারী ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। গোধূলির আলোতে কিছুক্ষণ বসে থেকে আমাদের জন্য নির্ধারিত বাংলোতে প্রবেশ করে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পুরো রিসোর্টটি ঘুরে দেখতে। বিশাল এক মাঠকে কেন্দ্র করে তিন দিকে প্রায় ২৫টি বাংলো, যার প্রতিটিতে ৩–৪টি পরিবার থাকতে পারে আর বাকি এক দিকে প্রবেশপথ, রিসেপশন ও লন, ডাইনিং আর সুইমিংপুল রয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির ফুলগাছ ও আকাশছোঁয়া বৃক্ষরাজিতে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ।

পরদিন ভোরে রিসোর্ট ম্যানেজারের পরামর্শ অনুযায়ী সূর্যোদয় দেখতে সোজা লনে চলে আসি। চাপড়ামারী অভয়ারণ্য আর মেঘের ফাঁকে সূর্যের লাল আলোর লুকোচুরি স্মরণীয় করে রাখল আমাদের ডুয়ার্সের প্রথম সকাল। ঘণ্টাখানেক হাঁটাহাঁটি করে নাস্তা শেষে রেডি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। এবারের গন্তব্য সামসিং হয়ে রকি আইল্যান্ড। সামসিং জলপাইগুড়ি আর দার্জিলিং জেলার সীমান্তে তিন হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত একটি পাহাড়ি এলাকা। নয়নাভিরাম চা–বাগান, গহীন বনাঞ্চলঘেরা পাহাড়ি নদী ও অনেকগুলো ট্যুরিস্ট স্পট নিয়ে এটি এখন ডুয়ার্সের অন্যতম আকর্ষণ।

পাহাড়ী নদী, পাথুরে নদী

গাড়িতে করে রকি আইল্যান্ড যাওয়ার পথের প্রতিটি জায়গাই যেন একেকটা পিকনিক স্পট—রাস্তার দুই পাশে বিশাল বিশাল শতবর্ষী গাছ, বুনোফুলের নজরকাড়া বাহারি রং আবার কোথাও যত দূর চোখ যায়, সবুজ চা–বাগান। সামসিং থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে মূর্তি নদীর তীরে রকি আইল্যান্ড ক্যাম্পিং ও ঘুরে বেড়ানোর আদর্শ স্থান। শীতল বাতাস ও চমৎকার আবহাওয়ার রকি আইল্যান্ড থেকে আকাশ পরিষ্কার থাকলে ভুটানের পাহাড়চূড়াগুলো দেখা যায়। ছোট–বড় পাথরে ঠাসা এই নদীতে শীতকালে হেঁটে হেঁটে অনেক দূর যাওয়া যায়। উজ্জ্বল রোদে, পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানিতে নানা ধরনের মাছের ছোটাছুটি দেখতে দেখতে অনেকক্ষণ কাটিয়ে গরম গরম মম আর চা খেয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম সামসিংয়ের আরেক আকর্ষণ লালিগুরাস হয়ে ভারত–ভুটান সীমান্তের বিন্দু গ্রামের দিকে এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিন্দুতে পৌঁছে গেলাম।

বিন্দু কালিম্পং জেলার ভুটান সীমান্তবর্তী ছোট গ্রাম, যেখানে সিকিমের কুপুপ লেক থেকে উৎপন্ন হওয়া জলঢাকা নদী ভারতে প্রবেশ করার পর বাংলাদেশে এসে ধরলা নদীর সঙ্গে মিলে ব্রহ্মপুত্রে মিশেছে। এখানে জলঢাকা নদীর ওপরে ভারতের অন্যতম প্রাচীন বাঁধ ‘বিন্দু ব্যারাজের’ মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পানি সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পাথরপূর্ণ এই জলধারা ও চারদিকের প্রকৃতি অনেকটা রকি আইল্যান্ডের মতোই। অনেক আগে দুপুর গড়িয়ে গেলেও এখানে মজা করে থুকপা (হাতে বানানো নুডলস সুপ) আর ফ্রায়েড রাইস খেয়ে লোকাল কমলা কিনে খেতে খেতে ফিরতি পথ ধরলাম।

ডুয়ার্সের প্রকৃতি এখনো বন্য

অভ্যাস অনুযায়ী ড্রাইভারকে বললাম অন্য পথ ধরে ফিরতে; পথিমধ্যে ঝালং ভিউ পয়েন্টে চা খেতে খেতে দূর থেকে বয়ে যাওয়া জলঢাকা নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করে পুরো চাপড়ামারী অভয়ারণ্য অতিক্রম করা পিচঢালা পথ পেরিয়ে মূর্তি লজের কাছে মূর্তি নদীতে সূর্যাস্ত দেখে ফিরে এলাম রিসোর্টে। বলে রাখা ভালো, আমরা এ যাত্রায় জঙ্গল সাফারি করিনি; তাই আপন মনে বিচরণ করা ময়ূর, বানর আর নানা পাখি ছাড়া তেমন কোনো বন্য প্রাণী দেখিনি; ওদের দেখতে হলে ডুয়ার্সের জন্য আপনাকে অন্তত চার রাত বরাদ্দ রাখতে হবে অথবা আমার মতো একাধিকবার যাওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে।