দুই বছর আগে এভারেস্ট বেজক্যাম্প দেখে আসার পর থেকেই বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করেছে রডোডেনড্রনের কাছে, পাইনবনে, পাথরভরা পার্বত্য পথে। বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর আবার সেই অসীমের পথে যাত্রা...

নামচে বাজার থেকে অনেকটা চড়াই পেরিয়ে খুমজুং। সেখানে ট্রেকিংয়ের পথ দুই ভাগ হয়ে গেছে। ডান দিকে ইবিসির (এভারেস্ট বেজক্যাম্প) পথ চলে গেছে থিয়াংবোচের দিকে। আর বাঁ দিকে ওপরে উঠে গেছে গোকিও যাওয়ার পথ। সে পথে কিছু দূর যেতেই শেষ হয়ে আসে পাইনবন। ঝাউ ও অন্যান্য ঝোপঝাড়ের সঙ্গে মিশে রয়েছে অসংখ্য ফুলের গাছ। উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ! বেশির ভাগই গোলাপি বা বেগুনি। নিচে দেখে এসেছি, ফুল ঝরে গেছে। কিন্তু এই উঁচুতে মে মাসেও রডোডেনড্রন ফোটার বিরাম নেই।
দুবছর আগে এভারেস্ট বেজক্যাম্প দেখে আসার পর থেকেই বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করেছে রডোডেনড্রনের কাছে, পাইনবনে, পাথরভরা পার্বত্য পথে। তুষার ঢাকা পর্বতশিখরের কাছাকাছি। বয়স ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর আবার সেই অসীমের পথে যাত্রার পরিকল্পনা শুরু করি গত বছরের অক্টোবরে। করোনাবন্দী দুটো বছর কাটিয়ে এই বসন্তে আবার হিমালয়ে যাত্রা করব। শেষ পর্যন্ত রোজা ও ঈদের জন্য একটু দেরি হয়ে যায়। ৫ মে করলাম যাত্রা।
তার আগে নেপালের গাইড তেজ ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছি, কোন দিকে কত দূর যাব। অন্য পথে হলেও বারবার এভারেস্টের কাছে যেতে চাই। কিছু খোঁজাখুঁজি, কিছু গবেষণার পর স্থির করি, এবার যাব গোকিওতে। ইবিসির সারা পথে এভারেস্ট যেমন দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক ভালোভাবে দেখা যায় গোকিও রি থেকে।
গোকিওতে ১৫ হাজার ৫৮৩ ফুট উচ্চতায় চারপাশের পাহাড় আর তুষারাবৃত উঁচু উঁচু পর্বতশিখরের মাঝখানে রয়েছে কয়েকটি লেক। শীতে সেসব লেক জমাট বেঁধে যায়। লেকের বরফ গলতে শুরু করে এপ্রিলে। সেই মোহনীয় দৃশ্য দেখতে ইচ্ছে করে। তা ছাড়া এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হিমবাহ গোজুমপা আছে এখানেই। গোকিও রির চূড়ায় উঠে দেখা যায় দূরের ও কাছের সব পর্বতশিখর, বিশেষ করে চো ইউ পর্বত। শুনেছি বিশেষ করে সূর্যোদয়ের সময় ওখান থেকে মাউন্ট এভারেস্টের অনেকখানি দেখা যায়। আর দেখা যায় পুমোরি, তাবুচে, চোলাচে ও থামশেরকুর মতো সব চেনা শিখর। কিন্তু গোকিও থেকে গোকিও রির শীর্ষে পৌঁছানো মানে অনেকখানি পর্বতারোহণ। ৫ হাজার ৩৫৭ মিটার। ভাবতে একটুও ভয় করে না। কারণ, এতে আছে অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি।
অ্যামেজিং নেপাল ট্রেক অ্যান্ড এক্সপিডিশনের নির্মলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এই ট্রেক করব বলে স্থির করি। গোকিও রির শীর্ষে উঠতে পারব কি না, পরে দেখা যাবে। আপাতত গোকিও পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। লুকলা থেকে হেঁটে রওনা হয়ে প্রথম ফাকদিংয়ে রাত্রিযাপন। তারপর অ্যাক্লাইমেটাইজেশনের (উচ্চতা, তাপমাত্রাসহ পরিবেশের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নেওয়া) জন্য দুদিন কাটাতে হয় নামচে বাজারে। নামচে বাজার একটা ছোটখাটো থামেল। কাঠমান্ডুর থামেলের মতোই জামাকাপড়, ট্রেকিংয়ের সরঞ্জাম ও কারুপণ্যের দোকান। আছে ছোট ছোট ক্যাফে ও বার, এমনকি একটা বড়সড় আইরিশ পাব। অল্প একটু জায়গার মধ্যে নানা মানের অনেক লজ। পরের দিন সকালবেলা সেখান থেকে যাত্রা শুরু করতেই ৩০ মিনিটের খাড়া চড়াই। তারপর দেড় ঘণ্টা খানিকটা সমতল, খানিকটা ধীর চড়াই পার হয়ে খুংজুমে পৌঁছে কফি বিরতি নিই। এরপর আবার ৩০ মিনিটের খাড়া চড়াই আর দেড় ঘণ্টার ক্রমাগত উঁচুতে ওঠা শেষ করে দুপুরে খাওয়ার জন্য থামি। সেটা ৩ হাজার ৯৫০ মিটার উচ্চতায় মংলাদাদা নামের একটা জায়গায়। এরপর এক ঘণ্টা খাড়া উতরাই পথে নিচে নেমে যেতে হয়। নেমে যাই একেবারে দুধকোশি নদীর কিনারে।
দুধকোশি চমৎকার নাচ জানে। যাত্রাপথে কতবার কত জায়গায় দেখেছি, তবু প্রতিটি জায়গায় নদীটিকে নতুন লাগে। নতুন লাগে তার নৃত্যের প্রতিটি ভঙ্গি। ছোটবড় অসংখ্য পাথরের ওপর সগর্জন ঝাঁপিয়ে পড়া নদীর দুধসাদা উচ্ছল জলধারা দেখি। শুনি তার কলস্বর। এখানে নদীর কাছে পৌঁছানোর আগে একটা বড় ঝরনা দেখে এসেছি। আরেকটু এগোতেই আরও একটা চমৎকার ঝরনা দেখতে পাই। আরও দুই ঘণ্টা হেঁটে ৪ হাজার ১১০ মিটার উচ্চতায় ডোলে পৌঁছাই। প্রায় সারা দিন লেগে গেল। এই যাত্রাপথে এক দিনে এটাই সবচেয়ে দীর্ঘ পথ—২৬ হাজার ৫০০ পদক্ষেপ। প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয় সাত ঘণ্টায়।
পরের দিন ডোলের ইয়েতি ইন থেকে রওনা হয়ে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় পৌঁছে যাই আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। ৪ হাজার ৪৭০ মিটার উচ্চতায় মাছেরমো। তাশিদেল লজ। নামচে বাজার থেকেই শীত বোধ করছিলাম। এখানে তা প্রবল হলো। বিছানায় ইলেকট্রিক কম্বল নেই। বাইরে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। তারই মধ্যে বিকেলে বেশ খানিকটা হেঁটে উঁচুতে উঠে আবার নেমে আসি। এটাই অ্যাক্লাইমেটাইজেশন হাইক। ব্রিটিশ তরুণ-তরুণীদের ছয়জনের দল, ভারতীয় দুই মেয়ে আর আমি—সবাই লাউঞ্জে বসে গল্প করি অনেকক্ষণ। বিকেল থেকেই সেই ঘরে ফায়ারপ্লেস জ্বালানো হয়। সন্ধ্যায় খাওয়ার সময় ঘরটা পুরো গরম হয়ে ওঠে। সবার খাওয়া শেষ হলে ধীরে ধীরে নিভে আসে আগুন। এখানে ওয়াইফাই কাজ করছে না। আমরা যার যার ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
রাতে হাড়কাঁপানো শীত। পরদিন ঘুম ভাঙতেই দেখি চারদিক ভোরের রোদে ঝলমল করছে। উজ্জ্বল নীল আকাশের নিচে হাঁটতে ভালো লাগে। চারপাশে ছোটবড় সব তুষার ঢাকা পর্বতশিখর দেখতে পাই। মাছেরমো থেকে সকালে রওনা হয়ে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাই গোকিওতে।
গোকিও পৌঁছানোর ঠিক আগে প্রথম লেক ও দ্বিতীয় লেক। ছোট ঝিল। চারপাশের পাহাড় আর নীল আকাশের পটভূমিতে নির্জন নিঃশব্দ প্রকৃতি আমাদের স্বাগত জানায়। টলটলে জল পান্নার মতো সবুজ। তাতে চারপাশের পাহাড় ও পর্বতশিখরের ছায়া পড়ে। দুপুররোদের সেই রূপবতী লেক দেখে আমি মোহিত হই। তৃতীয় লেকটাই সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে বেশি সুন্দর। লেকের পাড়ে ছোট–বড় বেশ কয়েকটি হোটেল ও লজ। আমাদের থাকার ব্যবস্থা ফিটজরয় হোটেলে। তার প্রতিটি জানালা দিয়ে লেক ও পাহাড় দেখা যায়।
দুপুরের পর থেকেই চারদিক মেঘাচ্ছন্ন। দূরের পর্বতশিখর তো দূরের কথা, কাছের পাহাড়, লেক কিছুই দেখা যায় না। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে। সঙ্গে আছে প্রবল বাতাস। আজ আর হিমবাহ দেখা হলো না। কাল ভোরে গোকিও রির চূড়ায় উঠে পর্বতশিখর দেখার সময় এই হিমবাহের অনেকখানি দেখা যাবে।
রাতে ডালভাত খাওয়া শেষে তেজ বলে রাখে, যদি রাতে মেঘ কেটে যায়, আকাশে তারা দেখা যায়, তাহলে আমাকে সে সাড়ে তিনটায় ডেকে দেবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে রাতের অন্ধকারেই আমরা যাত্রা শুরু করব। পাহাড়ের গা বেয়ে, পাথর ডিঙিয়ে ওপরে উঠতে আমার সময় লাগবে বেশি। তাই একটু আগে রওনা হলে সূর্যোদয়ের আগেই অনেকটা ওপরে উঠে যেতে পারব। ভোরের প্রথম আলোয় দেখতে পারব মাউন্ট এভারেস্টসহ অন্য সব পর্বতশিখর।
প্রতিদিন রাত ৯টার মধ্যে আমরা ঘুমাতে যাই। কয়েকবার ঘুম ভাঙলেও ভোর ছয়টার আগে পর্যাপ্ত ঘুম হয়ে যায়। আজও তেমনি রাত নয়টায় শুয়ে পড়েছি। রাত একটু গভীর হওয়ার পর ঘুম ভেঙে গেলে পর্দা সরিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াই। কী অপরূপ উজ্জ্বল রাতের আকাশ! আকাশে এত তারা আমি আর কোথাও দেখিনি। তাহলে একটা চমৎকার সূর্যোদয় দেখতে পাব! রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে নীল আকাশ আর শুভ্র তুষার ঢাকা পর্বতশিখর দেখতে পাব! আবার শুয়ে থাকি। উত্তেজনায় ঘুম আসে না। তেজ আমাকে ডেকে তোলার অনেক আগেই নিজে উঠে তৈরি হয়ে নিই। পৌনে চারটায় আমি আর তেজ যার যার কপালে বাঁধা হেডল্যাম্পের আলোয় পথ দেখে পাথর ও জলাভূমি ছাড়িয়ে পাহাড়ের পায়ের কাছে পৌঁছে যাই। পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করি। রাতের অন্ধকারে পাথর ডিঙিয়ে, ছোট ছোট পা ফেলে খাড়া চড়াই ধরে এঁকেবেঁকে উঠতে থাকি। এভাবে ঘণ্টাখানেক ওঠার পর তেজ আমাকে ডেকে দেখায়, নিচে আমাদের হোটেলের সামনে আরও কয়েকজনের হেডল্যাম্পের আলো এগিয়ে আসছে। অর্থাৎ অন্যরাও আসছে।
সেদিকে তাকিয়ে দেখার মতো সময় নেই। পরিষ্কার আকাশে কত তারা জ্বলছে, তা–ও ভালোভাবে দেখা হয়নি। আমার সমস্ত মনোযোগ পায়ের কাছে। মাটি ও পাথরের দিকে দৃষ্টি। ঠিকমতো পা ফেলে খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠি। আমাদের পরে যাত্রা শুরু করেও বেন, রিচার্ড, মাইকেল এবং আরও কিছু তরুণ-তরুণী আমাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়।
আরও কিছুক্ষণ এভাবে হাঁটার পর সূর্যোদয় দেখি। পর্বতশিখরের পেছন থেকে সূর্য ওঠে বলে প্রথম কয়েক মিনিট সেই আলো দেখা যায় না, পাহাড়গুলো অন্ধকার দেখায়। কয়েক মিনিট পরই একসঙ্গে সব ঝলমল করে ওঠে। ওই তো লোৎসে, আর ওই তো এভারেস্ট, তার থেকে অল্প দূরে ওই যে প্রিয় পুমোরি। এক প্রান্তে থামশেরকু আর একেবারে অন্য প্রান্তে চো ইউ।
বেশির ভাগ পর্বতশিখর এখন আমি চিনতে পারি। তেজ বলে না দিলেও অসুবিধা হয় না। কষ্ট হয় বাকিটুকু হেঁটে পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছাতে। শেষ ৩০ মিনিটকে প্রথম এক ঘণ্টার মতো দীর্ঘ লাগে। চারদিকের প্যানারোমিক ভিউ দেখে আর সর্বোচ্চ শিখরগুলোর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আমাকে উৎসাহ দেয় অন্য সবাই। বাকি দূরত্বটুকু পার হয়ে কখন কীভাবে যেন লক্ষ্যে পৌঁছে যাই। প্রার্থনা-পতাকা আর নানা রঙের কাপড়ে সাজানো গোকিও রির শীর্ষে দাঁড়িয়ে আনন্দ ও উত্তেজনা অনুভব করি। ‘গোকিও রি ৫৩৫৭ মিটার’—লেখাটির সামনে বেন আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানায়। আমার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য দাঁড়ায়। আবার এসেছি হিমালয়ে! সবার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রোদঝলমলে সকাল দেখি। মেঘ-পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা দেখি। পাথর ও বরফ বুকে নিয়ে শুয়ে থাকা বিশাল হিমবাহ দেখি। এই অপরূপ ও অসীম প্রকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নত ও নীরব হয়ে থাকি।