
শ্রীলঙ্কার উত্তরের বিন্দুর নাম ‘পয়েন্ট পেড্রো’; আর সবচেয়ে দক্ষিণের বিন্দুটি ‘পয়েন্ট ডন্ড্রা’। মাঝখানে প্রায় ৫৫০ কিলোমিটার। এ পথেই হেঁটেছেন এভারেস্ট ও লোৎসে শৃঙ্গজয়ী বাংলাদেশি পর্বতারোহী বাবর আলী
আমাদের ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।
২০১৯ সালে হেঁটে দেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণের পর পদব্রজে লম্বা ভ্রমণে বেরোনো হয় না দীর্ঘদিন। লম্বা হাঁটার জন্য অনেক দিন ধরেই আমার বাকেট লিস্টে ছিল শ্রীলঙ্কা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা ‘আমরা’ কবিতায় পড়া ‘সিংহল’ নামটা সেই কত আগে থেকে মনে গাঁথা ছিল। তৎকালীন বঙ্গ কিংবা ওডিশার এক বিতাড়িত রাজপুত্র বিজয়সিংহ অকূল সমুদ্রে নাও ভাসাতে ভাসাতে সেরেনটিভু নামের এক রাজ্যে কূলের দেখা পান। ‘সেরেনটিভু’র বাংলা করলে দাঁড়ায়—‘পাহাড়িদের দ্বীপ’। ৭০০ অনুসারীকে নিয়ে নতুন এ রাজ্যের দখল নেন বিজয়সিংহ। ভূখণ্ডটির নতুন নাম রাখেন সিংহল। শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে পুরোনো গ্রন্থ মহাবংস বলছে, বিজয়সিংহের বংশধরেরাই আজকের সিংহলি। অবশ্য শুধু সিংহলিই তো নয়, এই দ্বীপরাষ্ট্রে থাকে শ্রীলঙ্কান তামিল, মুর মুসলিম, বারগারস, ভারতীয় তামিলসহ নানা জাতিসত্তার মানুষ। ২৬ বছরব্যাপী গৃহযুদ্ধ আর সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার পর কেমন আছে সেই শ্রীলঙ্কা, স্বচক্ষে সেটা দেখার একটা ইচ্ছাও ছিল। আর বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলোই–বা কেন একে বিশ্বের সেরা দ্বীপ বলেছিলেন, সেটা জানার লোভও কম ছিল না।
কিন্তু সময়ের পুঁজি না মেলাতে বারবার পিছু হটতে হচ্ছিল। অবশেষে সেটা মিলতেই ১৭ দিনের হাঁটার পরিকল্পনা নিয়ে সেপ্টেম্বরের বর্ষণমুখর এক রাতে ফিটস এয়ারের ফ্লাইটে চড়ে বসলাম। সঙ্গী জুমন ভাই ও সাইফুল ভাই। লম্বা পদব্রজ ভ্রমণে সঙ্গী নিয়ে বেরোনোর একটা মুশকিল আছে। স্থানীয়দের সঙ্গে ভাববিনিময়ের সুযোগ কিছুটা হলেও কমে যায়। অন্য পিঠে স্বভাষী কারও সঙ্গ পাওয়াটাও অবশ্য কম লাভ না।
শ্রীলঙ্কার সর্ব–উত্তরের বিন্দু পয়েন্ট পেড্রোর সাকোটাই কেপ থেকে সর্বদক্ষিণের বিন্দু পয়েন্ট ডন্ড্রা অবধি হাঁটার পরিকল্পনা। অনেকটাই আমাদের দেশের টেকনাফ-তেঁতুলিয়া হাঁটার মতো। গুগল ম্যাপের দেখানো পথে আমাদের হাঁটা রুটের এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুর দূরত্ব ৫৩০ কিলোমিটারের মতো। তবে সে পথ কলম্বো হয়ে উপকূলরেখা ছুঁয়ে অন্য অন্তে পৌঁছেছে। বাঁধা পথের পথিক হতে আমাদের বেজায় আপত্তি। উপকূলের একঘেয়েমি কাটাতে আমরা সেটা এড়িয়ে বেছে নিলাম অপেক্ষাকৃত লম্বা দূরত্বের ৬১৫ কিলোমিটারের রুট। শ্রীলঙ্কার একেবারে হৃৎপিণ্ডের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে পয়েন্ট ডন্ড্রায় গিয়ে মিশেছে এই রাস্তা।
২৭ সেপ্টেম্বর সকালে অপরিচয়ের উত্তেজনা নিয়ে যে পথে হাঁটতে শুরু করেছিলাম, ১৩ অক্টোবরের পড়ন্ত বিকেলে সে পথ যখন শেষ হলো, অপরিচয়ের কুয়াশা তত দিনে কিছুটা হলেও অপসৃত। তত দিনে এই দেশের অনেক ধুলা–মাটি-কাদা শরীরে মাখিয়েছি। চলতে চলতে শ্রীলঙ্কার পথে-প্রান্তরে, খাঁজে-ভাঁজে লুকিয়ে থাকা নানা বিস্ময়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। গৃহযুদ্ধের অন্তিম ঘণ্টা বাজার এত বছর পরও মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মাইনফিল্ড দেখে আলোড়িত হয়েছি। স্থলমাইন পোঁতা এসব ভূমিতে ডিমাইনিংয়ের কাজ এখনো চলমান। মাইনে কত লোকের জীবনাবসান কিংবা অঙ্গচ্ছেদ হয়েছে। জীবনের পাশাপাশি আদিগন্তবিস্তৃত স্থলমাইন পোঁতা এসব মাঠের কারণে জীবিকাতেও এসেছে স্থবিরতা। এসব মাঠের মালিকেরা আক্ষরিক অর্থেই নিষ্ফলা মাঠের কৃষক।
হাঁটা নামের অ্যাকটিভিটি চলাকালীন চোখ-কানের পাশাপাশি মনটাকেও খোলা রেখেছি। পা ফেলতে ফেলতেই আত্মস্থ করতে চেয়েছি যাত্রাপথের অসীম সৌন্দর্য। দুচোখ ভরে দেখেছি প্রকৃতি। মনের মধ্যে আবার উঁকি দিয়েছে সেই প্রশ্ন, প্রকৃতির চেয়ে মহৎ কোনো শিল্পী কি আদৌ আছে? মাঝেমধ্যেই ক্যামেরার দ্বারস্থ হয়েছি। অবশ্য মনুষ্য নির্মিত ক্যামেরা কি আর প্রকৃতির সুধা পুরোটা ধরতে পারে?
পিচঢালা মসৃণ মহাসড়কের পাশাপাশি অনেক ছোট রাস্তার ধুলাও আমাদের পায়ে লেগেছে। অপেক্ষাকৃত কম ব্যস্ত এসব সড়কে পথচলাটা দারুণ আনন্দের ছিল। উভা প্রদেশের লাল মাটি ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক্সকাভেটরের ধাতব দাঁতে আটকে গেছে চোখ। পৃথিবীর গর্ভ খুঁড়ে উত্তোলন করা হচ্ছে রত্নপাথর। চা, কফি, রাবার ছাড়াও শ্রীলঙ্কা যে রত্নের জন্যও বিখ্যাত। সেন্ট্রাল প্রভিন্সের উত্তুঙ্গ পাহাড়ের সারি দিগন্তেই আটকে দিয়েছে চোখ। এল্লার লিটল অ্যাডামস পিকের চূড়া থেকে দেখা দূর পর্বতের ঢেউ এখনো আন্দোলিত করে দেহ-মন। রাস্তার ধারের অসংখ্য মাইলফলকের পাশাপাশি ফেলে এসেছি কত মানুষের ভালোবাসা। গাত্রবর্ণের কারণে স্বদেশি ভেবে সিংহলা কিংবা তামিল ভাষায় কথা বলতে এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। এই দুই ভাষায় আমাদের শব্দভান্ডার নিতান্তই অল্প বলে কথাবার্তা এরপরে এগিয়েছে হয় ইংরেজিতে নতুবা ইশারা-ইঙ্গিতে। শব্দের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই অবশ্য বাহুল্য ঠেকেছে আমাদের কাছে। চেহারায় পথের ছাপ পড়া পথিকদের জন্য ভিনদেশের এসব মানুষের উপচে পড়া আতিথ্যে কোথাও কমতি হয়নি। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ যে দুনিয়ার সব ভাষাতেই এক! বর্ণিল এই দ্বীপের মানুষের গাত্রবর্ণ কালো কিংবা বাদামি হতে পারে, তবে মনের রং একটাই—সাদা।
এ যাত্রায় শ্রীলঙ্কার ৯টি প্রদেশের ৬টিতে পা রাখার সুযোগ হয়েছে। তার মধ্যে আলাদা হয়ে থাকবে নর্থ আর নর্থ-সেন্ট্রাল প্রভিন্স। এই দুই প্রদেশের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-খাবারের বেলায় শ্রীলঙ্কার চেয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের সাদৃশ্য বেশি। একটু ভালোভাবে খেয়াল করলেই বহিঃ–অন্তঃপ্রকৃতিতে সহজেই এ ছাপের দেখা মেলে। এই সাযুজ্যের জন্যই গৃহযুদ্ধ চলাকালীন তামিল গেরিলা দলগুলো সহানুভূতির মোড়কে পেয়েছে ভারতের আনুকূল্য।
সিংহলি-তামিল নামের দুই জাতিসত্তার বিভেদের ফলস্বরূপ নেমে আসা গৃহযুদ্ধের নানা স্মৃতি-ভাস্কর্য ছড়িয়ে আছে দ্বীপদেশটির গাঁটে গাঁটে। কিন্তু সে কেবলই একপেশে ইতিহাস; বিজিতের দীর্ঘশ্বাস এতে লেখা নেই। এই অগৌরবের ইতিহাসই এখন আইনসংগত। কে জানে আসলেই তা ন্যায়সংগত কি না! এ বৃত্তান্ত আর এসব ভাস্কর্য লাগোয়া সাইনবোর্ডে চোখ বোলালে ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্রের মোহভঙ্গই হয় কেবল। অবশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখেছি প্রাচীন নগর সভ্যতার উজ্জ্বলতম নিদর্শন লায়ন রক নামে পরিচিত সিগিরিয়া। দুই হাজার বছরের কালের আঁচড় সামলেও এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে দুনিয়ার এই অষ্টম আশ্চর্য! দ্বীপদেশটিতে ঠিক তেমনিভাবে নড়বড়ে ইট ফুঁড়ে ওঠা বট-অশ্বত্থের গাছ ধারণ করে আছে পর্তুগিজ-ডাচ্ কিংবা ব্রিটিশ শাসনামলে তৈরি ঔপনিবেশিক স্থাপত্যরুচির প্রচুর দুর্গ কিংবা স্থাপনা।
শ্রীলঙ্কার পথেঘাটে চায়ের দোকানও অত সহজে মেলে না, যতটা বিনা ক্লেশে পাওয়া যায় লটারির দোকান। রীতিমতো সরকারি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হয় এসব লটারি।
পথের ধারের সাদামাটা মাইলপোস্টগুলো খুব বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ না করলেও সহজেই চোখ আটকায় রংবেরঙের যাত্রীছাউনিগুলোতে। যাত্রীছাউনির গ্রাফিতিগুলো শিল্পীর সূক্ষ্ম আঁচড়ে বর্ণিল। প্রতিটি ছাউনিই যেন একটুকরা শ্রীলঙ্কা। মাপে সব ছাউনিই এক হলেও ধাঁচে প্রতিটিই অনন্য।
রাস্তায় সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি অসংখ্য পথতরু। তুলসীগন্ধী মটমটিয়া, পরশপিপুল যেমন ছিল; তেমনি ছিল সর্বগ্রাসী বিজাতীয় উদ্ভিদ ক্যাশিয়া। বিত্তের সঙ্গে কুরুচির কোনো যোগ নেই, শ্রীলঙ্কানদের বাড়িঘর দেখলেই এটা বোঝা যায়। কোথাও বাহুল্যের ঝনঝনানি নেই, কিন্তু যেটুকু প্রয়োজন সেটা আছে। বিত্ত অল্প থাকুক, বৈভবের ছটায় তারা উজ্জ্বল।
যাত্রাপথজুড়েই ছিল হাতি পারাপারের অসংখ্য করিডর আর অভয়ারণ্য। হাতি শাকাহারী বলে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা শঙ্কিত ছিলাম না! অন্য জীব প্রেম করে জিব দিয়ে, এমন প্রাণী থাকলে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হতো! শ্রীলঙ্কার পতাকায় সিংহের উপস্থিতি থাকলেও প্রাণীটি এ ভূখণ্ডে নেই। সে তুলনায় হরেদরে মেলে হাতি। যেকোনো বড় আর বিখ্যাত বৌদ্ধবিহারে সহজেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। হণ্টনের সময়ে অবশ্য আমাদের হাতির মুখোমুখি হতে হয়নি। পারস্পরিক অসাক্ষাৎ আমাদের দুই প্রজাতির জন্যই ভালো হয়েছে বলে আমার ধারণা!
পথচলতি যে প্রাণীটি নিয়মিত দেখেছি, সেটি হলো ময়ূর। বঙ্গদেশে যেমন কাক, সেথা ময়ূরও তেমন। পেখম তোলা, উড়ন্ত, খেতে খাবার খুঁটতে থাকা কিংবা আসুরিক ডাকে সবাইকে তটস্থ করে ফেলা—সব রকমের ময়ূরের সঙ্গেই সাক্ষাৎ হয়েছে।
লকলকে জিব বের করা কর্কশ চামড়ার গুইসাপের দেখা রাস্তার পাশে হরহামেশাই পেয়েছি। এসব সরীসৃপ মানুষের সাহচর্যে অভ্যস্ত বলে বসতবাড়ির আশপাশেই ঘোরাফেরা করে।
আমাদের জন্য বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছিল মানকুলাম আর কালেকান্ডা রিজার্ভ ফরেস্ট। প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রলম্বিত ঠোঁটের অনিন্দ্যসুন্দর বিহঙ্গ ধনেশ দেখার সুযোগ পেয়ে আমরা আত্মহারা।
যাত্রাপথে প্রকৃতিও নানাভাবে পরীক্ষায় ফেলেছে। শ্রীলঙ্কার উত্তরে হাঁটার সময় প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে। মরীচিকা কাঁপা রাস্তা কিংবা মরীচিকা সৃষ্ট জলের হাতছানির বিভ্রম নিয়ে পেরিয়েছি মাইলের পর মাইল। লালচক্ষু সূর্যকে উপেক্ষা করে পেরিয়ে গেছি কত নিষ্ফলা মাঠ বা প্রান্তর। সেন্ট্রাল প্রভিন্সে ভীমদর্শন সব চড়াই পরীক্ষায় ফেললেও উতরাই পথে নেমেছি দুই পাকে ডানা করে। মাঝে বারকয়েক বাগড়া বসিয়েছে বৃষ্টি। শেষ দিনে চারপাশ ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া গামলা-ঢালা বর্ষণ বেশ বেকায়দাতেই ফেলেছিল।
পায়ের পাশাপাশি রসনাও থেমে থাকেনি। স্বাদেন্দ্রিয়কে নানা বৈচিত্র্য উপহার দিয়ে গেছে এই দেশের বাহারি সব খাবার। রুটি কুচি কুচি করে বানানো কত্তু, পিট্টু কিংবা সেগুনপাতায় মোড়ানো গুড় আর নারকেলের পুর দেওয়া হেলাপ্পার কথা মনে থাকবে বহুদিন। পথের ধারে গজিয়ে ওঠা ছোট্ট সব দোকানে খাওয়া ইডিয়াপ্পাম আর এগ হপারসের স্বাদ যেন এখনো জিবে লেগে আছে। শ্রীলঙ্কার পথের ধারের খাবার আমাদের দেশের পথেঘাটের খাবারের তুলনায় কিছুটা ব্যয়বহুল। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ‘হেলা বজুন হালা’ নামের শ্রীলঙ্কাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এক দোকান। মধ্যবয়স্ক নারীদের দ্বারা পরিচালিত এই দোকানের খাবার পেট আর পকেট—দুইখানেই সহনীয়। স্বাদ আর পরিচ্ছন্নতার দিক থেকেও এরা অনন্য।
গৌতম বুদ্ধকে শ্রীলঙ্কানরা মোক্ষজ্ঞানে বক্ষে ধারণ করে। শ্রীলঙ্কার পথেঘাটে ভগবান তথাগতের উজ্জ্বল উপস্থিতি। অশ্বত্থতলের ধ্যানী ও মৌনী শাক্যমুনি বুদ্ধ ছাড়াও লঙ্কাজুড়ে আছে অসংখ্য স্তূপ, চৈত্য আর বিহার। বৌদ্ধধর্মের তীর্থস্থান হিসেবেও দেশটির নামডাক আছে। শ্রীলঙ্কার পবিত্র নগর অনুরাধাপুরার পথে চলতে চলতে বুদ্ধ প্রচারিত ধর্ম ও দর্শনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আলোকত্ব প্রাপ্তির পরে বুদ্ধ শ্রীলঙ্কার যে জায়গায় প্রথম পা রেখেছিলেন, ভোরের আলোয় সেই মাহিয়ানগানার শান্ত, সমাহিত রূপ মনে থাকবে বহুদিন। তলার বুদ্ধদেব ছাড়াও দেশজুড়ে নৈবেদ্য পান শিব-পার্বতীর দুই পুত্র কার্তিক আর গণেশ। এদের স্থান বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বটের নিশ্ছিদ্র ছায়ায়। আর দ্রাবিড়ীয় স্থাপত্যরীতির ছোট ছোট মূর্তিতে আগাপাছতলা মোড়ানো ধর্মমন্দিরগুলো তো আছেই।
পথের শেষে কী আছে, সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হাঁটা শুরুর ১৭তম দিনের বিকেলে মাতারা জেলার সমুদ্রধৌত বেলাভূমি পয়েন্ট ডন্ড্রায় পৌঁছালাম। হাঁটা শেষ করার আনন্দকে ছাপিয়ে গেল উথলে ওঠা বিষাদ। কাল থেকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে নেই নতুন কোনো পথ; মুখে কৌতূহল, চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে কেউ ভাঙা ইংরেজিতে জানতে চাইবে না, ‘কোথায় চললে?’ নতুন নতুন জায়গায় সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত দেখার আনন্দ থেকেও বঞ্চিত হতে হবে কাল থেকে।
জাতিগত বিভেদ, গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কিংবা কোভিড–পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দায় মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থা থেকে যেভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা, রাষ্ট্র হিসেবে আমরা তা শিখতে পারি। একই সঙ্গে নাগরিক হিসেবেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। নাগরিকদের কাছে যেসব আচরণ প্রত্যাশা করে রাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কানরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে সেসব অতীব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলা থেকে শুরু করে রাস্তা পারাপারের সময় পথচারীর ট্রাফিক আইন মানা—সবখানেই সেই সুশীলনের ছাপ।
ফেরার সময় সমাগত। চেনা চৌহদ্দির বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিত হতে আমি সব সময় উন্মুখ হয়ে থাকি। শ্রীলঙ্কা নামের দেশটির সঙ্গে সেই পরিচয় বর্ণনাতীত আনন্দে ভরা। আমার ছেঁড়াখোঁড়া জীবনের ছোট্ট একটা অংশ বর্ণিল এই দ্বীপরাষ্ট্রের ধূলিতে মিশে রইল।